দুই বছর আগে স্থানীয় বাজার থেকে ৬২ হাজার টাকায় পাকিস্তানি সিংড়ি জাতের একটি ষাঁড় কেনেন নওগাঁর রফিকুল ইসলাম। তার মেয়ে রিমা গরুটির নাম রাখে ‘বাদশা’। সেই থেকে পরম যত্নে ষাঁড়টিকে লালন-পালন করে কিশোরী। এটি হয়ে যায় তার পরিবারের অংশ।
কিন্তু দুই বছরের সে বন্ধনে ইতি ঘটতে পারে এবারের ঈদুল আজহার আগেই। প্রিয় ষাঁড়টিকে ছেড়ে দিতে হতে পারে রিমার।
তার বাবা রফিকুল ষাঁড়টির দাম হাঁকিয়েছেন ১৫ লাখ। এ দামে কেউ কিনলেই রিমার ষাঁড় চলে যাবে অন্য কারও উঠানে।
নওগাঁর মান্দার নলঘোর গ্রামের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। পেশায় মিষ্টির দোকানি। মিষ্টি তৈরি করে স্থানীয় পীরপালি বাজারে বিক্রি করেন। মিষ্টি বিক্রির লাভের টাকা দিয়ে ২০১৯ সালে ছাঁতড়া গরুর হাট থেকে তিনি কিনেছিলেন ষাঁড়টি।
রফিকুল জানান, বেশ কয়েকজন ক্রেতা গরুটির দাম ১১ লাখ টাকা পর্যন্ত দাম বলেছেন। তবে ১৫ লাখ না হলে তিনি এটি বিক্রি করবেন না।
প্রায় ২২ মণ ওজনের ষাঁড়টি উচ্চতায় ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি; চওড়ায় ৯ ফুট ১০ ইঞ্চি। রং টকটকে লাল। বিশাল আকৃতির বাদশাকে দেখতে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছেন অসংখ্য মানুষ; আসছেন গরু কেনার জন্য দূর-দূরান্তের ক্রেতারাও।
মন খারাপ রিমার
বাদশার বিক্রির কথা শুনে মন খারাপ হয় রিমার। সে বলে, ‘আব্বু যখন ষাঁড় কিনে এনেছিল তখন আমি নাম দিয়েছিলাম বাদশা। করোনায় আমার স্কুল প্রায় ১৫ মাস থেকে বন্ধ। তাই বাদশাকে আমিই বেশি দেখাশোনা করি।
‘বাদশাকে গোসল করানো, খাবার দেয়া, গোয়ালঘরে রাতে কয়েল দেয়া, অসুস্থ হলে ওষুধ খাওয়ানো, সব আমি করছি। বাদশার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে সেও মাথা নাড়িয়ে তার মাথা আমার কোলে দেয়। বাদশার ক্ষুধা লাগলে বা অসুস্থ হলে আমি ঠিকই বুঝতে পারি।’
স্থানীয় একটি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রিমা বলে, ‘মনটা চাইছে না বাদশাকে বিক্রি করে দিতে। কিন্তু তাও বিক্রি করতে হবে। তবে একটু ভালো দাম পেলে আব্বুকে বলেছি লাভের টাকা দিয়ে আরেকটি ষাঁড় গরু যেন কিনে দেয়। আবার ষাঁড় গরু কিনলে তার নামও দিব বাদশা।’
‘মেলা ধরনের খাবার খিলান লাগিছে’
ষাঁড়টির মালিক রফিকুলের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্ট করা হামার (আমার) মিষ্টির দোকানের ১ বছরের লাভের টেকা দিয়া ষাঁড়ডা কিনিছি। কিনা আনার পর হামার মেয়েডা নাম দিছিল বাদশা। হামি আর হামার বউ কাজে ব্যস্ত থাকায় মেয়েডাই বেশি যত্ন লিছে (নিয়েছে)।
‘মেলা ধরনের খাবার খিলান (খাওয়ানো) লাগিছে। ভাত, মাষকলাই, মসুরের ছোলা, গুঁড়া, খৈল, মোটা ভুসি, আলু, ভুট্টা, কাঁচা ঘাস নিয়মিত খিলাছি। মাঝে মাঝে কলাও খিলাছি। দিন-রাত মিলা পাঁচ-ছয়বার খাবার দেয়া লাগে।’
বাদশার পেছনে দৈনিক খরচ নিয়ে রফিকুল বলেন, ‘প্রতিদিন হামার বাদশার জন্নি নানা রকম খাবার দেওয়া লাগিছে। ৩৫০-৪০০ টেকার খরচ করা লাগিছে বাদশার প্রতিদিন খাবার খরচ বাবদ। আর মাঝে মাঝে তো নানা ধরনের অসুখ হলে মেলা টেকা চলা যায় পশু ডাক্তারোক বাড়ি আনা চিকিৎসা করান লাগে।
‘ওষুধ খরচ মেলা পড়া যায় যখন অসুখ হয় বাদশার। গরু হলে কী হবে, তারও তো জীবন আছে। সব মিলা এ পর্যন্ত হামার প্রায় সাড়ে ৫ লাখ থাকা ৬ লাখের মতো খরচ হছে বাদশার জন্নি।’
মেয়ের ইচ্ছা অনুযায়ী বাদশাকে বিক্রির টাকা দিয়ে আরেকটি ষাঁড় কেনার কথা জানান রফিকুল।
তিনি বলেন, ‘হামার মেয়েডার বাদশার জন্নি খুব মায়া জন্মা গেছে। বেচার কথা শুনার পর মনডা খুবই খারাপ করা আছে। এখন কী আর করমু, বেচা তো লাগবেই। তয় বাদশাক বেচার পর আবার লাভের টেকা দিয়া একটা ষাঁড় গরু কিনা দিমু।’
বাদশার দরদাম
রফিকুল বলেন, ‘প্রতিদিনই মেলা জাগাত থ্যাকা লোকজন আসিচ্ছে বাদশাক কিনার জন্নি। একন পর্যন্ত ১০ থাকা ১১ লাখ পর্যন্ত দাম কছে। হামি ১৫ লাখ দাম চাচ্ছি। তয় সবাই হামার বাদশাক তো কিনবে না। যারা বড়লোক মানুষ এ্যানা (একটু) বড় দেকা (দেখে) মোটাতাজা গরু কিনবার চায়, তারাই কিনবে। এখন দেকা যাক কী হয়।
‘করোনার কারণে তো ম্যালা জাগাত থাকা মানুষ আসবার পারিচ্ছে না। মেলা জাগাত লকডাইন চলিচ্ছে। যদি লকডাউন না থাকলোনি হয়তো আরও মেলা মানুষ হামার বাদশাডাক অ্যাসা দেকে (এসে দেখে) পছন্দ করা কিনবার পারলোনি (কিনতে পারত)। আবার শুনিচ্ছি গরুর হাট নাকি বন্ধ থাকপে; লওগাঁর ডিসি স্যার নাকি ঘোষণা দিছে। তালে বাদশাক তো হাটোতও লিয়্যা (হাটে নিয়ে) যাবার পারমু না।’
রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ এ্যানা দুডা টেকা বেশি লাভের জন্নি মেলা কষ্ট করা লালন-পালন করা বড় করা তুলিছি। একন যদি কোরবানির কারণে দাম ভালো পাই তয় এ্যানা লাভ করা পারমু।
‘আর লাভের টেকা দিয়া সংসারের খরচ চালামু আর আরেকটা গরু কিনমু বলা ইচ্ছা আছে।’
স্থানীয় বাসিন্দা সাহাজুল ইসলাম বলেন, ‘এত বড় ষাঁড় গরু হামি কোনো দিন সামনাসামনি দেকিনি। রফিকুল ভাই ২ বছর আগে গরুডা কিনা বড় করা তুলিছে। সামনে ঈদ। তাই বেচার চেষ্টা করিচ্ছে। ভালো দাম পালে বেচবে।’
পার্শ্ববর্তী পীরপালি গ্রামের বাসিন্দা আবুল হোসেন বলেন, ‘হামরা একই এলাকার লোক। রফিকুল ভাইয়ের মিষ্টির দোকান আছে পীরপালি বাজারোত। তার মেয়ে গরুডার নাম দিছে বাদশা। এত বড় গরু হামি এর আগে কুন্টি (কোথাও) দেকিনি।’
আসাদ হোসেন নামের একজন এসেছেন বাদশাকে কিনতে। এ সময় নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা সাতজন মিলে কোরবানির গরু কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ঈদের আর অল্প কিছুদিন সময় আছে। তবে একটু আগেই গরু কিনে বাসায় রেখে পরিচর্যা করে কোরবানি দিতে চাই।
‘গরুটি দেখতে অনেক সুন্দর ও মোটাতাজা। যারা শখ করে একটু বড় মাপের গরু কোরবানি দিতে চায়, তারাই মূলত এ ধরনের ষাঁড় কিনবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ষাঁড়টির মালিক ১৫ লাখ টাকা দাম চেয়েছেন। আমরা ১১ লাখ টাকা পর্যন্ত বলেছি।
‘তাকে ভাবার সময় দিয়েছি। যদি একটু কম-বেশি করে দাম বলে, তবে আমরা গরুটি কিনব।’