ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে প্রতিবছরই ভাঙন দেখা দেয়। বন্যার কবলে পড়ে সর্বস্বান্ত হতে হয় ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার লক্ষাধিক মানুষকে।
বন্যা থেকে রক্ষা পেতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলেও সেই বাঁধ কোনো কাজে আসছে না। ভাঙনকবলিত স্থানেই প্রতিবছর ভাঙছে বাঁধ। প্রতিবছর তা মেরামতের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
স্থায়ী সমাধান না করে শুধু বাঁধ মেরামতে অর্থের অপচয় হচ্ছে বলে মনে করেন স্থানীয় মানুষ। তারা দুষছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতাকে। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড উল্টো দুষছে স্থানীয়দের। তারা বলছে, বাঁধ যেখানে বানানো দরকার, সেখানে জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহির উদ্দিন জানান, এই নদীর দুই তীরে ১২২ কিলোমিটার বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের মধ্যে ৭৫ কিলোমিটার রয়েছে নদীর ধার ঘেঁষে, যা এই বাঁধ ভাঙার অন্যতম কারণ। এ ছাড়া নদীশাসন ও সংস্কার না করায় প্রতিবছরই ভাঙছে বেড়িবাঁধ।
তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে ফেনীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সাতটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। সেই ভাঙন মেরামতের জন্য ৩৯ লাখ ১২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কাজগুলো পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ফেনী ইউনাইটেড কনস্ট্রাকশন, মেসার্স কাশেম ট্রেডার্স, মেসার্স ইমেজ এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স শাহ সুফি এন্টারপ্রাইজ।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২টি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। সেই ভাঙনকবলিত স্থানগুলো মেরামতের জন্য ১ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫টি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। সেগুলো মেরামতের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয় ২৯ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে আটটি স্থানে ভাঙন দেখা দিলে সেগুলো মেরামতের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
২০২১ সালের চলতি জুন মাসে মুহুরী নদীতে একটি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সেখানে বরাদ্দ দেয়ার আবেদন করা হয়েছে।
ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলাকে বন্যা থেকে রক্ষায় ২০০৫ সালে শুরু হয়ে ২০১১ সাল পর্যন্ত সময়ে নির্মিত হয় ২২২ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ। এতে ব্যয় ২৫৫ কোটি টাকা।
এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ভারী বর্ষণ হলেই ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে দেখা দেয় ভাঙন। প্রতিবছর এই বাঁধের বিভিন্ন স্থান ভেঙে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলের মাঠ ভেসে যায়।
এ বছরের শুরুতেই মুহুরী নদীর ফুলগাজীর উত্তর শ্রীপুর গ্রামের জয়নাল ড্রাইভারের বাড়ির পাশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে করে নিচু এলাকা প্লাবিত হয়। আট মাস আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে মুহুরী নদীর আটটি স্থানে বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ১৫টি গ্রাম। সে কাজ শেষ হতেই গত ১ নভেম্বর মুহুরী ও কহুয়া নদীর দুটি স্থানে বাঁধ ভেঙে ৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় পাকা আমন ধানের। এ ছাড়া মৎস্য খামার, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি হয়।
ফুলগাজী উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম বলেন, ‘একই জায়গা বারবার ভাঙে। তা মেরামতের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়। আবার একই ঠিকাদার কাজ পায়। বন্যা হলে কিছু অসাধু কর্মকর্তার কপাল খুলে যায়। পাউবো কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় খামখেয়ালিভাবে ঠিকাদাররা যেনতেনভাবে মেরামতের কাজ করছেন। যার কারণে একই জায়গা বারবার ভাঙছে। আর মানুষ বারবার ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম মজুমদার ও জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘বেড়িবাঁধ নির্মাণের পর থেকে প্রতিবছর একাধিকার এই বাঁধের একাধিক স্থানে ভাঙছে। মুহুরী ও কহুয়া নদীর একটি স্থায়ী সমাধান করা হোক। বেড়িবাঁধ ভাঙার কারণ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতা। এই বাঁধকে নদী থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া হোক।’
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক মো. নাছির উদ্দিন বলেন, জমি অধিগ্রহণ করার সময় স্থানীয়রা বাধা দেয়ায় বাঁধকে নদী থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেয়া যায়নি। এ কারণে বাঁধ ভাঙছে। স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করার প্রক্রিয়া রয়েছে। ইতোমধ্যে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন শীঘ্রই পাওয়া যাবে। কারিগরি কমিটির সুপারিশের আলোকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। একনেকে অনুমোদনের পর বাস্তবায়ন হবে। বাঁধ সংস্কারে কর্মকর্তাদের কোনো গাফিলতি নেই।’
ফেনীর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজজামান বলেন, টেকসই বাঁধ না হওয়ার কারণে বেঁডিবাধ ভেঙে যায়। নদীতে বাঁধগুলো সংস্কার করা দরকার। প্রতিবছরই এমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড যৌথভাবে কাজ করলে স্থায়ী সমাধান করা সম্ভব হবে।