করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের দেয়া লকডাউন বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে রয়েছে গাজীপুরের প্রশাসন।
জেলায় লকডাউনের প্রথম দিনে ঢিলেঢালাভাব থাকলেও বুধবার দ্বিতীয় দিনে পুলিশের তৎপরতা ছিল একটু বেশি। সকাল থেকে রাজধানীর প্রবেশমুখ আব্দুল্লাহপুর, কামাড়পাড়া ও টঙ্গী ব্রিজ এলাকায় ঢাকা মেট্রোপলিটন ও গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক তল্লাশি চৌকি দেখা গেছে।
এছাড়া নরসিংদী হয়ে গাজীপুরে ঢুকতে ঘোড়াশাল ব্রিজ, ময়মনসিংহ সীমানায় শ্রীপুরের জৈনা বাজার, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কালিয়াকৈর ও জয়দেবপুর চৌরাস্তা এলাকায় পুলিশের একাধিক তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে।
রাজধানী থেকে সারাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করে সোমবার গাজীপুরসহ সাতটি জেলায় কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সরকার।
মঙ্গলবার রাত থেকে রাজধানীর সঙ্গে বন্ধ রয়েছে সারাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাও। ফলে রাজধানীর সঙ্গে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সারাদেশ।
চেকপোস্টে জরুরি সেবা ও পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ছাড়া সব ধরনের যানবাহন আটকে দিচ্ছে পুলিশ। তবে নানা কারণ দেখিয়ে পুলিশের তল্লাশি চৌকি পেরোতে চাইছেন সাধারণ মানুষ ও পরিবহন চালকরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পোশাক কারখানার শিপমেন্ট ও হাসপাতালে চিকিৎসার কথা বলছেন তারা।
বুধবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানী ও গাজীপুরের প্রবেশমুখ টঙ্গী বাজারে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের দুপাশে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের তল্লাশি চৌকি বসানো হয়েছে। সেখানে পুলিশের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিলেন গাজীপুর জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাব্বির আহমেদ।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে পুলিশ শুধুমাত্র জরুরি সেবা অ্যাম্বুলেন্স ও পণ্যবাহী ট্রাক-কাভার্ডভ্যানগুলো তল্লাশি চৌকি পার হতে দিচ্ছেন। এছাড়া সব ধরনের যানবাহন রাজধানী থেকে গাজীপুরে প্রবেশ এবং গাজীপুর থেকে রাজধানীতে প্রবেশের সময় বাধার সম্মুখীন হতে দেখা গেছে। অনেকেই আবার বাধার মুখে পড়ে গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর সামনে এগিয়ে আবার সিএনজি ও অটোরিকশায় করে গন্তব্যে যাচ্ছেন।
দুপুরে বাধার মুখে পড়ে গাড়ি থেকে নেমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বেশ কয়েকজনকে কথা বলতে দেখা যায়। বিভিন্ন পোশাক কারখানার কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কেউ কেউ গাজীপুরে ঢোকার অনুমতি চাইলেও কঠোর ছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট সাব্বির আহমেদ। শুধু পোশাক কারখানার পণ্যবাহী গাড়ি ছাড়া সকল ব্যক্তিগত গাড়ি ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন তিনি।
সুইসটেক প্রিন্টার্স লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান থেকে পোশাক কারখানার মালামাল নিয়ে ঢাকা থেকে গাজীপুরের মাওনার উদ্দেশে যাচ্ছিলেন কাভার্ডভ্যান চালক শাহীন। আব্দুল্লাহপুর পেরিয়ে গাজীপুরে ঢুকতেই টঙ্গী ব্রিজে তাকে আটকে দেয় পুলিশ।
সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট সাব্বির আহমেদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখিয়েও গাজীপুরে ঢোকার অনুমতি পাননি তিনি।
শাহিন বলেন, ‘ঢাকা থেকে গাজীপুরের মাওনার একটি পোশাক কারখানার জন্য লেভেল ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে মাওনা যাচ্ছিলাম। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট কিছুতেই গাজীপুরে ঢুকতে দিচ্ছেন না।
শেরপুর থেকে ৪২তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসেছিলেন সামান্তা ফেরদৌস। ২০ জুন তারিখ ছিল মৌখিক পরীক্ষার নির্ধারিত দিন। পরে সেটি বাতিল হয়ে যায়।
বুধবার ঢাকা থেকে শেরপুর ফেরার পথে গাজীপুরের প্রবেশমুখ টঙ্গী বাজারে তার গাড়ি আটকে দেয় পুলিশ। পরে সামান্তা ফেরদৌস গাড়ি থেকে নেমে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাব্বির আহমেদের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে বিসিএস পরীক্ষার্থী পরিচয় দেন। কিন্তু নির্বাহী ম্যাজিস্টেট সাব্বির ছিলেন কঠোর।
গাজীপুর লকডাউনের আওতায় জানিয়ে ওই পরীক্ষার্থীকে বিকল্প রাস্তায় গন্তব্যে যাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। এসময় বেশ কিছুক্ষণ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও বিসিএস পরীক্ষার্থী সামান্তার মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়।
এর কিছুক্ষণ পর পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আটকা পড়েন ট্রাস্ট নীটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার নুকুল কুমার মাহাতু।
এসময় তিনি পুলিশ ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে বিজিএমইএর একটি প্রত্যয়নপত্র দেখান। বিজিএমইএ সচিব কমডোর মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক (অব.) স্বাক্ষরিত ওই প্রত্যয়নপত্রে ট্রাস্ট নীটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজের বেশ কয়েকটি গাড়ির নম্বর উল্লেখ করে গাড়িগুলোকে লকডাউন থাকার সময় গার্মেন্টস শিল্পের জরুরি রপ্তানি কাজে চলাচলের অনুমতি প্রদান ও সম্ভাব্য সকল সহযোগিতার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু ওই প্রত্যয়নপত্র প্রত্যাখ্যান করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।
এসময় ট্রাস্ট নীটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার নুকুল কুমার মাহাতু ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘আমি একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আমি কারখানায় যেতে না পারলে শিপমেন্ট বাতিল হয়ে যাবে। বিজিএমইএ থেকে শিল্প ও পোশাক কারখানা সংশ্লিষ্ট সকলকে লকডাউনে চলাচলের অনুমতি দিলেও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে কোনোভাবেই গাজীপুরে ঢুকতে দিচ্ছেন না।’
গাজীপুর জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ঢাকার পাশের জেলা গাজীপুর লকডাউন করা হয়েছে। এসময়ে পণ্য পরিবহন ও জরুরি সেবায় নিয়োজিত যানবাহন চলাচলের অনুমতি থাকলেও অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সড়কে বের হয়েছেন। প্রথম দিন আমরা মানুষকে লকডাউন মেনে চলার জন্য সচেতনতামূলক কাজ করেছি। কিন্তু নানা অজুহাতে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সড়কে বের হচ্ছে। তাই আমাদেরকে কঠোর হতে হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধুমাত্র পণ্যবাহী ও জরুরি পরিষেবায় নিয়োজিত পরিবহনকে আমরা সড়কে চলাচল করতে দিচ্ছি। কোনো ব্যক্তিগত পরিবহন চলাচল করতে দেয়া হবেনা। আমরা অনুরোধ করব, আগামি ৩০ জুন পর্যন্ত লকডাউন কার্যকর করার জন্য সকলে যেন তাদের প্রয়োজনীয় কাজ বিকল্প উপায়ে করেন।’
এদিকে শিল্পকারখানা অধ্যুষিত গাজীপুরের পোশাক কারখানাগুলো লকডাউনে খোলা থাকায় সকাল থেকেই সড়কে দেখা গেছে শ্রমিকদের। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় শ্রমিকরা পায়ে হেঁটে এবং রিকশায় চড়ে তাদের কর্মস্থলে যোগ দিয়েছে। বিকেলে কারখানা ছুটির পর ফের শ্রমিকদের পায়ে হেঁটে এবং ছোট ছোট যানবাহনে চড়ে বাসায় ফিরতে দেখা গেছে।
একাধিক শ্রমিক ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, কারখানা খোলা কিন্তু সড়কে কোনো গণপরিবহন নেই। সড়কে কিছু সিএনজি ও অটোরিকশা চললেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে কয়েকগুণ বেশি। উত্তরা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তায় যেতে জনপ্রতি ২০ টাকার ভাড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। ফলে নিরুপায় হয়ে পায়ে হেঁটে ভেঙে ভেঙে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে।
গাজীপুর জেলা সিভিল সার্জন ডা. খাইরুজ্জামান জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজীপুরে ২৯৩ জনের দেহে নমুনা পরীক্ষা করে নতুন করে আরও ৬০ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় করোনায় মোট শনাক্তের সংখ্যা ১২ হাজার ৯৬ জন।
তিনি জানান, ২৪ ঘণ্টায় গাজীপুরে নতুন করে আরও একজন করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ নিয়ে জেলায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ২২৮ জনে। সংক্রমণের দিক থেকে গাজীপুরে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে সদর ও সিটি করপোরেশন এলাকা।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘লকডাউন বাস্তবায়নে বিভিন্ন এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। মাস্ক ছাড়া কেউ বাইরে চলাচল করলে জরিমানা গুনতে হচ্ছে।’