বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মানের অংশ হিসেবে ‘গার্ড অফ অনার’ দেয়ার সময় নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতি নিয়ে আপত্তি তোলা সুপারিশ নাচকের খবরে স্বস্তি জানিয়েছেন নারী ইউএনওরা।
তারা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল সুপারিশটি। এটি আমলে না নেয়ায় শেষ পর্যন্ত নারীর মর্যাদা রক্ষা হয়েছে।
১৩ জুন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৯তম বৈঠক হয়। এ সময় বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর তাকে ‘গার্ড অফ অনার’ দেয়ার সময় নারী কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে আপত্তি জানিয়ে বিকল্প খোঁজার সুপারিশ করে কমিটি।
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পর তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানায় প্রশাসন। গার্ড অফ অনার দিতে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকেন জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। রাষ্ট্রীয় সম্মানের অংশ হিসেবে সরকারের প্রতিনিধি হয়ে মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধাও জানান ওই সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা।
বৈঠকের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান জানান, ধর্মীয় অনুভূতির জায়গা থেকে এমন সুপারিশ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্ন আসছে ধর্মীয় অনুভূতি থেকে। কোনো কোনো জায়গা থেকে বলা হয়েছে, জানাজায় নারীরা অংশ নিতে পারেন না।’
বৈঠকের এমন সুপারিশের খবর প্রকাশের পর থেকে দেশজুড়ে বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এ ধরনের সুপারিশ নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মন্তব্য করেন অনেকে। একই সঙ্গে ‘গার্ড অফ অনার’ ধর্মীয় বিষয় নয়, বরং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এমন আলোচনাও সামনে আসে।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় শামিল হন দেশের কয়েক উপজেলার নারী ইউএনওরা। তারা প্রশ্ন তোলেন, সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তা তো কর্মকর্তাই। এতে নারী-পুরুষের প্রশ্ন কেন আসবে?
এসব সমালোচনার মধ্যেই বুধবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, গার্ড অফ অনারে নারী কর্মকর্তার উপস্থিতিসংক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশ আমলে নেয়া হবে না।
সংসদীয় কমিটির ওই সুপারিশকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে লিঙ্গবৈষম্য করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা আমাদের সংবিধানের সংরক্ষণের জন্য শপথ নিয়েছি। কাজেই আমার এর বাইরে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে দেশের কয়েকজন নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে যোগাযোগ করে নিউজবাংলা।
নাটোরের বাগাতিপাড়ার ইউএনও প্রিয়াংকা দেবী পাল বলেন, ‘গার্ড অফ অনারে নারী কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণ বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত এসেছে, তা খুবই ইতিবাচক। সংসদীয় কমিটি সুপারিশ দিয়েছিল। সেটি মতামতের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হয়েছে। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে ভেবে ভালো লাগছে।’
লালপুর উপজেলা ইউএনও (ভারপ্রাপ্ত) শাম্মী আক্তার বলেন, ‘নারী কর্মকর্তাদের গার্ড অফ অনারে না থাকা বিষয়ে সংসদীয় কমিটি যে সুপারিশ করেছিল, তাতে আমরা খুবই অস্বস্তিতে ছিলাম। আপাতত আমাদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল সুপারিশটি।’
তিনি বলেন, ‘অংশগ্রহণ না করতে পারলে আমরা নিজেরাও হীনম্মন্যতায় ভুগতাম। শেষ পর্যন্ত নারীর মর্যাদা রক্ষা হয়েছে।’
নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ইউএনও চৈতী সর্ববিদ্যা বলেন, ‘সত্যি খবরটা শুনে ভালো লাগছে, আমি ব্যক্তিগতভাবে আনন্দিত। এর বেশি কিছু বলতে গেলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি লাগবে।’
জেলার কবিরহাট উপজেলার ইউএনও হাসিনা আক্তার বলেন, ‘এটা তো হওয়ারই ছিল। এটা ব্যক্তি নয়, একটি পদ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই হয়তো এমন সিদ্ধান্ত এসেছে।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন নাটোর থেকে নাজমুল হাসান এবং নোয়াখালী থেকে মোহাম্মদ সোহেল।