পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের অধ্যক্ষ বাহেজ উদ্দিনের সামনেই এক শিক্ষার্থীকে শ্রেণিকক্ষ থেকে তুলে ‘টর্চার সেলে’ নিয়ে মারধর করে ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে।
এ অভিযোগ এনে গত ২০ জুন পাবনা সদর থানায় মামলা করেছেন শরিফুল ইসলাম স্বাধীন নামে ওই শিক্ষার্থীর বাবা শাহজাহান আলী।
মামলায় অধ্যক্ষ বাহেজ উদ্দিন স্বাধীনকে ‘ক্যাম্পাসে কিছু না করে বাহিরে নিয়ে পেটাতে’ বলেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলাম মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অধ্যক্ষ বাহেজ অনার্স চতুর্থ বর্ষের এই শিক্ষার্থীকে তার সামনে থেকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও মারধরের বিষয়ে জানেন না বলে দাবি করেছেন। এ ঘটনায় তার কোনো ইন্ধন ছিল না বলেও দাবি অধ্যক্ষের।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী স্বাধীন বলছেন, অধ্যক্ষ বাহেজের বিরুদ্ধে উপবৃত্তির টাকা বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ জানিয়ে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দেয়ায় এমন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। একই কারণে এইচ এম সাব্বির নামে এক সহপাঠীকেও বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণ করেছে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা।
মামলায় বলা হয়, পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আলাউদ্দিন সরদার মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে আলোচনার জন্য গত ১৫ জুন শিক্ষার্থীদের ডেকে পাঠান। শরিফুল ইসলাম স্বাধীনও স্যারের কথায় ক্যম্পাসে যান।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক আলাউদ্দিনের উপস্থিতিতে স্বাধীনকে জোর করে বের করে নিয়ে যান ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির দপ্তর সম্পাদক সুমন হোসেনের নেতৃত্বে কলেজ কমিটির সহসভাপতি রাজিব হোসেন আলিফ, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সাব্বির আহমেদ জয়, জেলা ছাত্রলীগ সহসভাপতি তপু রায়হানসহ ৮-৯ জন বহিরাগত। এ সময় পাশের একটি কক্ষে নিয়ে স্বাধীনকে মারধর করতে থাকেন তারা। ছিনিয়ে নেয়া হয় তার মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ।
এজাহারে আরও বলা হয়েছে, শিক্ষক আলাউদ্দিন বিষয়টি তখনই অধ্যক্ষ বাহেজকে জানালে তিনি ঘটনাস্থলে আসেন। তবে তিনি স্বাধীনকে রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নেননি। উল্টো সন্ত্রাসীদের বলেন স্বাধীনকে ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়ে পেটাতে।
পরে সন্ত্রাসীরা স্বাধীনকে পাশের জুবলি ট্যাংক মার্কেটে নিয়ে মারধর শেষে লাথি দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয়। পথচারীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে কয়েক দিন চিকিৎসা শেষে চিকিৎসকের পরামর্শে এখন বাড়িতে বিশ্রামে আছেন স্বাধীন।
স্বাধীন বুধবার বিকেলে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর গরিব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা দেয় সরকার। সাধারণ শিক্ষার্থীদের না জানিয়ে, ওয়েবসাইটে কোনো নোটিশ না দিয়েই অধ্যক্ষ এক ঘনিষ্ঠজনের মাধ্যমে একটি তালিকা করে এই টাকা বিতরণ করেন।
‘আমরা অনিয়মের প্রতিবাদ জানিয়ে গত ২০ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি দিই। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে অধ্যক্ষ স্যার আমাদের শিক্ষাজীবনে প্রভাব পড়বে বলেও হুমকি দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্মাকলিপিতে সই করা এইচ এম সাব্বির নামে এক সহপাঠীকেও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণ করে। একই কারণে আমাকেও মারধর করা হয়েছে।’
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, ‘করোনার কারণে কলেজ বন্ধ থাকায় ক্যাম্পাসে যাইনি। ভাইভা নিয়ে আলোচনার জন্য ১৫ জুন স্যার ডেকে পাঠালে ক্যম্পাসে যাই। এ খবর পেয়ে বহিরাগত সন্ত্রাসীরা এসে স্যারের সামনেই মারধর শুরু করে। আলাউদ্দিন স্যার বিষয়টি অধ্যক্ষ স্যারকে জানান।
‘অধ্যক্ষ স্যার এসে আমাকে রক্ষায় কোনো উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো বাইরে নিয়ে পেটাতে বলেন। আমি বারবার আকুতি জানালেও তিনি কর্ণপাত করেননি। একপর্যায়ে জীবন রক্ষার্থে আমি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে সন্ত্রাসীরা আমাকে পাশের জুবলি ট্যাংক মার্কেটে তাদের টর্চার সেলে নিয়ে ব্যাপক মারধর করে। পরে লাথি দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেয়।’
স্বাধীন বলেন, ‘কলেজ ক্যাম্পাসের আশপাশে এই সন্ত্রাসীদের বেশ কয়েকটি টর্চার সেল আছে। তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই এসব টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হয়।’
ঘটনার ব্যাপারে জানতে নিউজবাংলা কথা বলেছে প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষক আলাউদ্দিন সরদারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘আমি শিক্ষার্থীদের ডেকেছিলাম। শ্রেণিকক্ষে কথা বলার সময় অতর্কিতে কয়েকজন যুবক এসে স্বাধীনকে ধরে পাশের একটি কক্ষে নিয়ে যায়। ঝামেলা আঁচ করতে পেরে তখনই বিষয়টি অধ্যক্ষ স্যারকে অবহিত করি। স্যার এসে কী করেছেন আমার জানা নেই।’
মামলায় কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির দপ্তর সম্পাদক সুমন হোসেনকে এক নম্বর আসামি করা হলেও তিনি বলছেন, ঘটনায় তিনি জড়িত নন।
সুমন হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীন কলেজের একটি মেয়েকে দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরই জেরে তাকে কিছু জুনিয়র শিক্ষার্থী পিটিয়েছে বলে শুনেছি। আমি এই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নই।’
সন্ত্রাসীদের হাতে শিক্ষার্থীকে তুলে দেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অধ্যক্ষ।
নিউজবাংলাকে বাহেজ উদ্দিন বলেন, ‘কলেজে ঝামেলার খবর শুনে আমি ঘটনাস্থলে যাই। সে সময় স্বাধীনকে মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে সে কিছু বলেনি। ওই শিক্ষার্থীরা পূর্বপরিচিত এবং বিষয়টি তাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। তারা স্বেচ্ছায় একসঙ্গে ক্যম্পাস থেকে বেরিয়ে গেছে। কলেজ ক্যম্পাসে মারধরের কোনো ঘটনা ঘটেনি। উপবৃত্তি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগও সত্য নয়।’
পাবনার পুলিশ সুপার মোহা. মহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি। অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ কাজ করছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’