ঘরের মালিকের সঙ্গে চুক্তি একটাই, থাকা যাবে কিন্তু মাঠের কাজে সহায়তা করতে হবে। নিজে দিনমজুরি খাটার পর বাড়ি এসে যা করাটা অমানুষিক পরিশ্রম ছিল। সামান্য কয়টা পয়সা রোজগার করে বাড়ি ফিরতে হতো চুপসানো বাজারের ব্যাগ নিয়ে। দৈনিক শ্রমিক হিসেবে যা পেতেন, তার তিন ভাগের এক ভাগ কমিশনে চলে যায়। বাকিটা দিয়ে সংসার চালানো বাবুল মিয়ার জন্য খুব কষ্টের। প্রধানমন্ত্রীর ঘর পেয়ে বাবুল বারবার আকাশের দিকে তাকান।
সদর উপজেলা পরিষদে বড় করে সাঁটানো প্রধানমন্ত্রীর ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এই মানুষটা আমার বাঁচতে শেখাল বাপ, অন্যের শ্রমিক হিসেবে আর নয়। নিজের ঘরে থাকব। কারও কথামতো আর ঘরে থাকা লাগবি না।’
৬৫ বছরের বাবুল মিয়ার মুখে হাসি। তবে সেই হাসির মাঝে রয়েছে যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে দাস হয়ে থাকার যন্ত্রণার ছায়া।
মাগুরা সদর উপজেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া ভূমিহীনদের জন্য ঘরগুলো পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বাবুল একজন। পরিষদ চত্বরে অন্য সব সুবিধাভোগীর মাঝে বসে আছেন বাবুল এবং তার স্ত্রী বিনু বেগম।
বাবুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘৩৫টি বছর ধরে মানষের বাড়ি থাকছি। তিনডা সন্তান বড় করছি। বড় দুটো মেয়ে। তাদের বিয়ে দিছি। ছাওয়ালডা এবার আমার সাথে মানষের বাড়িতে কাজ করে। কাজ না করলি ঘরে থাকা যায় না। ভাড়া নেয় না, কাজ করে উশুল করে দিতি হয় ঘর মালিকের।’
ঘর পাওয়া এই বৃদ্ধ বলেন, ‘গরিব মানুষ ঘর ভাড়া দিয়ে থাকব ক্যামনে। তাই ঘরে থাকার বিনিময়ে মালিকদের কাজ করে দিতি হয়। যে কারণে নিজের রোজগারে টান পড়ে। এহন আমি খুব খুশি। আমার ঘর দেছে শেখ হাসিনা। এই ঘরে আমার পরিবার থাকবি। এই দলিল আমার। এই ঘর আমার ভাবতি গিলি বারবার চোহি (চোখে) পানি আসেরে বাপ। শেখের মেয়ের মতো কেউ কোনো দিন আমাগোর দিক ফিরে চাইনেই।’
বাবুল মিয়ার স্ত্রী বানু বেগম বলেন, ‘পরের বাড়ি থাকতি হলি আমাগোর সবার কাজ করতি হতো সেই বাড়িওয়ালাল। ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য নেই রে বাপ। তাই গায় গতরে খেটে সেই ভাড়া শোধ করতি হতো। বলতি পারো পরের গোলাম হয়ে থাকা লাগছি বিয়ের পর থেকে।
‘৩৫ বছর বিয়ে হইছি এই মানসির সাতে। কোনো ঘরবাড়ি নেই, ভাল কাজ নেই। তাই টাকাও তেমন নেই। শুধু অভাব আর অভাবে চলিছি পোলা-মাইয়া নিয়ে। তাও মানসির ধরে দুইডা মেয়ের বিয়ে দিছি।
‘জামাইরা ভ্যান চালায় মাগুরায়। এহন আমার আনন্দ লাগতেছে যে আমাগের নিজেগের ঘরে কেউ কামলা খাটাতি পারবি নে।’
বাবুল মিয়া ঘর পেয়েছেন সদর উপজেলার শিবরামপুর এলাকায়। সেখানে তার ঘরের সঙ্গে রয়েছে আরও তিনটি ঘর। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় এসব ঘরের চারপাশে খোলা মাঠ।
মুজিববর্ষ উপলক্ষে দ্বিতীয় পর্যায়ে মাগুরার ১৯৫টি ঘর রোববার উপকারভোগীদের মাঝে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
মাগুরায় ১৯৫টি ঘরের মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৫টি, শ্রীপুরে ৪০, শালিখায় ৮০ এবং মহম্মদপুর উপজেলায় ৪০টি ঘর পয়েছেন উপকারভোগীরা। প্রতিটি পরিবারের নামে ২ শতক খাসজমি বরাদ্দ দিয়ে এসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ টাকা।
এর আগে মুজিববর্ষ উপলক্ষে প্রথম পর্যায়ে মাগুরার চার উপজেলায় ১১৫টি ঘর ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে দেয়া হয়।
জেলা প্রশাসক আশরাফুল আলম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাগুরাসহ দেশের সব জেলায় একযোগে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে জমি ও ঘর প্রদান কার্যক্রমের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানটি মাগুরাতেও সফলভাবে অনুষ্ঠিত হলো। ঘর পাওয়া মানুষদের হাতে তাদের জমি ও ঘরের সব রকম কাগজপত্র তুলে দেয়া হয়েছে।’
মাগুরা জেলার চারটি উপজেলায় ঘর বিতরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় সাংসদসহ জেলা প্রশাসক ড. আশরাফুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধি ও সব উপকারভোগী।