ময়মনসিংহে মাঝেমধ্যেই কবর থেকে কঙ্কাল চুরির ঘটনা ঘটছে। গত এক বছরে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় কবর থেকে অন্তত ২১টি কঙ্কাল চুরি হয়েছে। পুলিশের অভিযানে গত বছর একজন ধরা পড়লেও অনেকে থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
স্থানীয় অনেকের ধারণা, চুরি হওয়া কঙ্কাল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়; মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে হাতবদল হয়ে পৌঁছে যায় বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে।
তবে মেডিক্যাল কলেজ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসপাতালের মর্গে বেওয়ারিশ মরদেহ থাকায় চুরি করা কঙ্কাল মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে হয় না।
গত বুধবার (১৭ জুন) রাতে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের কেওয়াটখালী জামে মসজিদের গোরস্তানের তিনটি কবর খুঁড়ে কঙ্কাল চুরির অভিযোগ ওঠে। কিন্তু সেখানে দেখা যায়, চোরেরা কঙ্কালের বিভিন্ন অংশ নিলেও হাত ও পায়ের কিছু হাড়গোর কবরের পাশে ফেলে রেখে গেছে।
ফুলপুর উপজেলার চরবাহাদুরপুর গ্রামের ঈদগাহ মাঠ সংলগ্ন গোরস্থান থেকে ১০টি মরদেহ চুরির ঘটেছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এ ঘটনার পর চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি সকালে একই ইউনিয়নের চরনিয়ামত-বেলতলী গ্রামে কয়েকজন লোকের হাতে বস্তা দেখতে পায় স্থানীয় কৃষকরা।
আলুর বেপারি ভেবে দাঁড় করিয়ে তারা কৌতুহলবশত আলুর দরদাম নিয়ে কথা বলেন। কাছে গিয়ে বস্তায় কী আছে জিজ্ঞাসা করতে চোরেরা বস্তা রেখে পালিয়ে যায়। বস্তা খুলে দুটি খুলিসহ কঙ্কাল পাওয়া যায়।
গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর ত্রিশালের রামপুর ইউনিয়নের বীররামপুর ভাটিপাড়া গ্রামের ছাত্তার ড্রাইভারের পারিবারিক কবরস্থানের সাতটি কবর খুঁড়ে কঙ্কাল নিয়ে গেছে চোরেরা।
গফরগাঁও উপজেলার বারবাড়ীয়া ইউনিয়নের উত্তর নাওপাড়া এলাকায় গত বছরের ৫ মার্চ আরেকটি কঙ্কাল চুরি হয় কবর থেকে।
২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর রাতে আরেকটি কঙ্কাল চুরি হয় গফরগাঁও উপজেলার পাইথল ইউনিয়নের ডুবাইল গ্রামে।
এরপর ১২ অক্টোবর গভীর রাতে গফরগাঁও উপজেলার পাগলা থানার টেকপাড়া গ্রামের একটি পারিবারিক গোরস্থান থেকে কঙ্কাল চুরি হয়।
এর দুই থেকে তিন দিন আগে একই গ্রামের আরেকটি পারিবারিক গোরস্থানের কবর থেকে কঙ্কাল চুরি হয়েছে।
২০১৭-১৮ সালে এ রকম আরও ঘটনা ঘটে গৌরীপুরের ভাংনামারী ইউনিয়নের কুলিয়ারচর ও গজারিয়া গ্রামে, হালুয়াঘাটের ধারা ইউনিয়নের দড়িনগুয়া মাঠখলা কবরস্থানে, ফুলবাড়িয়ার হাটকালী বাজার এলাকার বুড়াইপার কবরস্থানে, মুক্তাগাছার রঘুনাথপুর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে ও ময়মনসিংহ সদর উপজেলার অষ্টধর ইউনিয়নের তারাপুর সেনের চর গ্রামে।
সবশেষ গত বুধবার গভীর রাতে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এলাকার কেওয়াটখালী জামে মসজিদের গোরস্থান থেকে তিনটি কঙ্কাল চুরি হয়।
গত বছরের ১৪ নভেম্বর রাতে নগরীর আর কে মিশন রোডের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ১২টি মাথার খুলি ও দুই বস্তা মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের হাড় উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় দুই কন্টেইনার তরল কেমিক্যাল ও তিন প্যাকেট গুড়া কেমিক্যালসহ বাপ্পি (২৫) নামের এক যুবককে আটক করা হয়।
প্রতিটি পূর্ণাঙ্গ কঙ্কাল ২০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা দামে পার্শ্ববর্তী হালুয়াঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হয়েছিল বলে স্বীকার করেন বাপ্পি।
তিনি পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, তারা কবর থেকে কঙ্কাল চুরি করে কেমিক্যাল বা দ্রুত পচনে সাহায্যকারী পদার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে কঙ্কাল পাচারকারীর চক্রের হাতে তুলে দেন।
মেডিক্যাল কলেজে অ্যানাটমি অধ্যয়নের কাজে ছাড়া কবর থেকে চুরি করা কঙ্কালের আর কোনো ব্যবহার আছে কি না, সেটা এখনও উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. চিত্তরঞ্জন দেবনাথ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হাসপাতালে যেসব লাশ বেওয়ারিশ হিসেবে পড়ে থাকে, সেগুলোকে আমরা আমাদের ডিপার্টমেন্টে নিয়ে আসি। এরপর শিক্ষার্থীরা শেখার জন্য লাশগুলোকে কাটাছেঁড়া করে দেখে শরীরের ভেতরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কোথায় কী আছে।’
তিনি বলেন, একেকটি হাড় খুব শক্ত করে জড়ানো থাকে মাংসের সঙ্গে। ফলে হাড় থেকে মাংস ছাড়ানোর জন্য বেওয়ারিশ লাশটিকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কেমিক্যালের মাধ্যমে প্রসেসিং করে হাড় থেকে মাংস আলাদা করেন।
কবর থেকে চুরি করা লাশ চোরাকারবারির মাধ্যমে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠদান কাজে চলে আসে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমাদের এখানে যথেষ্ট বেওয়ারিশ লাশ আছে, সেহেতু চুরি করা কঙ্কাল আমাদের কাছে আসার প্রয়োজন নেই। তবে চোর চক্রটি হয়তো লাশ চুরি করে প্রসেস করে কঙ্কাল করে বিক্রি করতেও পারে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন চিকিৎসক নিউজবাংলাকে জানান, একজন মেডিক্যাল শিক্ষার্থীকে প্রথম বর্ষেই অধ্যয়নের সুবিধার জন্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কঙ্কাল কিনতে হয়। একটি কঙ্কালের দাম পড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। সরকারি-বেসরকারি সব মেডিক্যাল শিক্ষার্থীরই কঙ্কাল প্রয়োজন হয়। তারা এসব কঙ্কাল কিনে নেন তৃতীয় বর্ষে ওঠা বড় ভাইদের কাছ থেকে।
তিনি আরও জানান, ‘এই কঙ্কালগুলো বড় ভাইয়েরা (তৃতীয় বর্ষ) যেকোনো মাধ্যমে সংগ্রহ করেন। অনেক ক্ষেত্রে বাইরের চোরাকারবারিদের কাছ থেকে এসব কঙ্কাল কেনা হয়।’
ময়মনসিংহ র্যাব-১৪ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘কবর থেকে লাশ কিংবা কঙ্কাল চুরির কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। তবে আমরা এই চোর চক্রটিকে ধরতে অনুসন্ধান চালাচ্ছি।’
এ বিষয়ে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মো. আহমার উজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কঙ্কালসহ বাপ্পিকে গ্রেপ্তারের পর আমরা তার কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছিলাম। সেই সূত্র ধরেই আমরা কাজ করছি। এগুলো যারা করছে তাদেরকে খোঁজা হচ্ছে।’