প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বরগুনার ছয়টি উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নে ভোট হতে যাচ্ছে ২১ জুন। ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। ভোটাররা বলছেন, নির্বাচনি প্রচারে ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার করে মাঠ দখলেই বেশি মরিয়া ছিলেন প্রার্থীরা।
দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রচার শুরুর পর বরগুনার বিভিন্ন ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয়েছেন একজন। আহত হয়েছেন শতাধিক নেতাকর্মী। এসব ঘটনায় আগ্নোয়াস্ত্রসহ বেশ কিছু দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ।
জেলা নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনার পাঁচ উপজেলায় ২৯টি ইউনিয়নের ২৬৫টি কেন্দ্রে ভোট অনুষ্ঠিত হবে। মোট ভোটার সংখ্যা চার লাখ ৯৬ হাজার ১২৬ জন। এদের মধ্যে নারী ভোটারের সংখ্যা দুই লাখ ৪৮ হাজার ৯৭১ জন ও পুরুষ ভোটারের সংখ্যা দুই লাখ ৪৭ হাজার ১৫৫ জন।
প্রচারে সহিংসতা ও আধিপত্য বিস্তার এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা করেছে জেলা পুলিশ।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কার্যালয়ে পাঠানো ওই তালিকায় ২৯টি ইউনিয়নের ২৬৫ কেন্দ্রের ৮১টিকে ঝুঁকিপূর্ণ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে বরগুনা সদর উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের ৩৪টি ভোটকেন্দ্র অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
স্থগিতের দ্বিতীয় দফায় ১১ জুন থেকে ইউপি নির্বাচনে প্রচারণা শুরুর পর সহিংসতায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পাঁচশর বেশি কর্মী-সমর্থক আহত হয়েছেন। এছাড়া নির্বাচনি প্রচারণায় প্রার্থীর সমর্থক ও কর্মীদের কাছ থেকে আগ্নোয়াস্ত্র, ককটেল ও দেশীয় অস্ত্রসহ লাঠিসোটা উদ্ধার করেছে পুলিশ।
১২ জুন শনিবার বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ ইউনিয়নের উত্তর করুনা গ্রামের খাল থেকে ইউসুফ আলী আকন নামে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ইউপি নির্বাচনকেন্দ্রিক বিরোধিতার জেরে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পরিবারের।
বরগুনার ২৯টি ইউনিয়নের মধ্যে সবেচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে সদর উপজেলার আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়নে। সহিংসতায় আহত হয়েছেন প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। ভাঙচুর করা হয়েছে বাড়ি-ঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে মোটরসাইকেল।
১২ জুন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মজিবুল হক কিসলু ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোশাররফ হোসেনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হন প্রায় ৩০ জন। দশটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় দুটি মোটরসাইকেলে। এ ঘটনায় উভয় প্রার্থীর পক্ষ থেকে পাল্টাপাল্টি হামলার অভিযোগ এনে একাধিক মামলাও হয়।
বৃহস্পতিবার বরগুনার পাথরঘাটায় নির্বাচনি প্রচারে মোটরসাইকেলে চড়ে অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়ার সময় আজিম হোসেন নামে একজনকে অস্ত্র ও গুলিসহ আটক করে পুলিশ। শর্তভঙ্গ করে নিবন্ধিত অস্ত্র নিয়ে নির্বাচনি প্রচারে অংশ নেয়ায় তাকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয় আদালত। প্রচার স্থগিতের আগেও ওই ইউনিয়নে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
বরগুনা সদরের বুড়িরচর ইউনিয়নেও নৌকার প্রার্থী সিদ্দিকুর রহমান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হুমায়ুন কবিরের সমর্থকদের মধ্যে একাধিকবার দফায় দফায় সংঘর্ষের হয়। আহত হন উভয় প্রার্থীর শতাধিক কর্মী-সমর্থক। সংঘর্ষে ব্যবহার হয় রামদা, টেঁটাসহ নানা ধরণের দেশীয় অস্ত্র। ভাঙচুর করা হয় মোটরসাইকেল।
শুক্রবার রাতে ইউনিয়নের কামড়াবাদ বাজারে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর প্রচার কার্যালয়ে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। শনিবার সকালে স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ সমর্থকদের ৪৬ জনকে আসামি করে বরগুনা থানায় মামলা হয়। এছাড়া জেলা সদরের নলটোনা, ফুলঝুড়ি, বেতাগী উপজেলার সদর, সরিষামুড়ি, আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী, পাথরঘাটার কাকচিড়া ও কাঠালতলীসহ বেশ কিছু ইউনিয়নে স্বতন্ত্র ও নৌকার সমর্থকদের মধ্যে সংর্ঘষের ঘটনা ঘটে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ভোট স্থগিতের আগে দশ দিন নির্বাচনি প্রচার চলে। নির্বাচন স্থগিত পর্যন্ত প্রচারের সময়ও বিভিন্ন ইউনিয়নে সংঘর্ষের ঘটনায় অন্তত দুইশ ব্যক্তি আহত হন। উদ্ধার হয় আগ্নোয়াস্ত্র ও ককটেল। এছাড়া সহিংসতায় জড়িয়ে যাওয়ায় বামন সদর ইউনিয়নের স্বতন্ত্র প্রার্থী সোহেল সিকদারকে আটক করে মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়।
ইউপি নির্বাচনের প্রচারে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনায় শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ নিয়ে শঙ্কায় ভোটাররা। চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরাও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কিত।
সদরের কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের ভোটার আবুল কালাম বলেন, ‘এইবার যেরকম মারামারি পিটাপিডি কোপাকুপি অইছে, ভোট দেতে কেন্দ্রে যামু কিনা সন্দেহ আছে।’
একইরকম বক্তব্য ২৯টি ইউনিয়নের প্রায় সব ভোটারদেরই।
বরগুনা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা দিলীপ কুমার বলেন, ‘বেশি ঝুঁকিপুর্ণ ভোট কেন্দ্রগুলোতে আমাদের স্পেশাল ফোর্স থাকবে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের কাছাকাছি ক্যাম্প স্থাপনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আমরা মিটিং করে রেখেছি।’
বরগুনার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর মল্লিক বলেন, ‘ঝুঁকিপুর্ণ এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়ন থাকবে। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োজিত থাকবে। কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য পুলিশ সতর্ক রয়েছে।’
প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ছিল ১৮ মার্চ, যাচাই ১৯ মার্চ, মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় ২৪ মার্চ আর ভোটগ্রহণের তারিখ ছিল ১১ এপ্রিল।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় নির্বাচন কমিশন ১ এপ্রিল ৩৭১ ইউপি ১১ পৌরসভাসহ লক্ষীপুর-২ আসনে নির্বাচন স্থগিত করে।
২ জুন নির্বাচন কমিশন এসব ইউনিয়নে নতুন করে ২১ জুন ভোট গ্রহণের তারিখ ঘোষণা করে।
প্রথম পর্যায়ের ইউপি নির্বাচনে বরগুনা জেলার ২৯টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে এক হাজার ৬১২ জন প্রার্থী হন। এদের মধ্যে বরগুনা সদর উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৪২ জন, আমতলির ৬টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৫১ জন, বেতাগী ৭টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ২৮ জন, পাথরঘাটার ৩টি ইউনিয়নে ২৭ জন, বামনার ৪টি ইউনিয়নে ২১ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন। এছাড়াও সংরক্ষিত পদে ৩৪৬ এবং সাধারণ সদস্য পদে এক হাজার ৭৯ জন মনোনয়নপত্র জমা দেন।