‘আত্মগোপনে’ গিয়ে আলোচিত হয়ে ওঠা ইসলামি বক্তা আবু ত্ব-হা মোহাম্মদ আদনান ঢাকায় দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে আসার সময় শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টে কেন গাইবান্ধায় চলে গেছেন, তার মনের ভেতর কী ছিল, সঙ্গীরা এই কয়দিন কোথায় কী করেছেন, তার সবই তিনি খুলে বলেছেন আদালতে।
তার আইনজীবী জানিয়েছেন, ত্ব-হার দুই স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা আছে। তিনি আদালতে সব কথা বলার পর এ কারণেই স্ত্রীদের কারও বদলে মায়ের জিম্মায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়।
গত ১০ জুন ত্ব-হা উধাও হয়ে যাওয়ার পর নানা কথাই ছড়িয়েছেন তার অনুসারীরা। তার ভক্তরা কেউ বলছিলেন, ইহুদিবাদীদের সমালোচনা করায় তাকে অপহরণ করা হয়েছে, যার পেছনে রয়েছে ইসরায়েল। কেউ বলছিলেন, এর পেছনে হাত ভারতের। কেউবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা, কেউবা পুলিশের দিকে আঙুল তুলছিলেন।
এর মধ্যে শুক্রবার ত্ব-হা ফিরে আসেন রংপুরে তার প্রথম স্ত্রীর বাসায়। তার ফিরে আসার দৃশ্য দেখেন স্থানীয়রা। মুহূর্তেই খবরটি ছড়িয়ে যায় বানের মতো। পুলিশ গিয়ে তাকে নিয়ে আসে।
পরে সংবাদ সম্মেলন করে গোয়েন্দা পুলিশ জানায়, ত্ব-হা এই কয়দিন গাইবান্ধায় তার এক বন্ধুর বাসায় ছিলেন। তিনি আত্মগোপন করেন ব্যক্তিগত কারণে। তবে কী সেই ব্যক্তিগত কারণ, সেই বিষয়টি পুলিশ এখনই জানাতে চায় না।
রাতে ত্ব-হাকে তোলা হয় রংপুরের আদালতে। আর তাকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন বিচারক।
খোঁজ পাওয়ার পর রাতেই আদালতে নেয়া হয় ত্ব-হাকেআদালতে ত্ব-হা যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তার বিস্তারিত জানতে পেরেছে নিউজবাংলা।
তবে আদালতে জবানবন্দি দিলেও বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চান না ক্রিকেটার থেকে ইসলামি বক্তা বনে যাওয়া এই তরুণ।
শনিবার রংপুরে বাসায় গেলেও তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তার মা আজেদা বেগম বলেছেন, কথা হবে পরে।
ত্ব-হার আইনজীবী সোলায়মান আহমেদ সিদ্দিকী বাবুর কাছে জানতে চাইলে তিনি এই জবানবন্দির বিষয়টি স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, ‘ত্ব-হা আদালতে ১৬৪ ধারায় জানিয়েছেন, উনি গাইবান্ধায় ছিলেন। তিনি নিজেই পারিবারিক অশান্তির কারণে নিখোঁজ ছিলেন। শুক্রবার প্রথম স্ত্রীর (আবিদা নূর) বাবার বাড়িতে আসছিলেন। ওনার সঙ্গীরাই ওনার সঙ্গে ছিলেন। যেহেতু দুই স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা ছিল, তাই তাকে তার মায়ের জিম্মায় দেয়া হয়েছে।’
ত্ব-হা নিখোঁজ হওয়ার পর তার মায়ের সাধারণ ডায়েরির তদন্ত কর্মকর্তা মজনু মিয়া বলেছেন, ‘ত্ব-হাসহ তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিয়েছেন। তাদের জবানবন্দিতে বিচারক সন্তুষ্টি জানিয়ে তাদের নিজ নিজ জিম্মায় ছেড়ে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘যে কারণে তারা ৮ দিন নিখোঁজ ছিলেন, সে বিষয়গুলো তারা তাদের জবানবন্দিতে বলেছেন।’
বগুড়া থেকে ঢাকায় যাত্রা
শুক্রবার রাতে রংপুর মেট্রোপলিটন আমলি আদালতের (কোতোয়ালি) বিচারক কে এম হাফিজুর রহমানের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ত্ব-হা।
এতে তিনি বলেন, ১১ জুন বগুড়ার শিবগঞ্জ ও ঢাকার সাভারে দুটি প্রোগ্রাম ছিল। এ জন্য বৃহস্পতিবার বিকেল চারটার দিকে রংপুর থেকে রওনা দেন বগুড়ার উদ্দেশে। কিছুদূর যাওয়ার পর তিনি আঁচ করে পারেন, বাইকে তাকে কেউ ফলো করছে। এ কারণে বগুড়ার সাতমাথা হয়ে আরেক রোড ধরে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।
তিনি জানান, কোনো এক কারণে বগুড়ার শিবগঞ্জের প্রোগ্রামটা বাতিল হয়। পরে তিনি ঢাকার সাভারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। টাঙ্গাইল পার হয়ে হেমায়েতপুরে এসে ধারণা করেন, বাইকে করে কেউ একজন তাকে আবার ফলো করছে।
তার সন্দেহ ছিল, যেহেতু তিনি ইউটিউবে ধর্মীয় বক্তব্য দেন, সে কারণেই ধর্মীয় কোনো উগ্রপন্থি তাকে ফলো করছে...।
এরপর তিনি সেখান থেকে দ্রুত ঢাকায় প্রবেশ করে উত্তরার আব্দুল্লাহপুরে একটি পাম্পে তেল নেন এবং দ্বিতীয় স্ত্রী সাবিকুন্নাহার সারাকে জানান যে, তিনি বাসায় আসছেন। তার অবস্থানের গুগল ম্যাপের একটি স্ক্রিনশটও শেয়ার করেন।
স্ত্রীকে বলেন, ‘আমার ১৮ মিনিট লাগবে আসতে।’
কিন্তু পরে তিনি ইউটার্ন করে আবার রংপুরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। তবে রংপুরে না এসে তার স্কুলবন্ধু সিয়ামের বাসায় যান।
সিয়ামের বাড়ি গাইবান্ধার ত্রিমোহনীতে।
ফোন বন্ধ টাঙ্গাইলে
জবানবন্দি অনুসারে রংপুর ফেরার পথে টাঙ্গাইলে এসে তিনি আশঙ্কা করেন যে, কারও হাতে আটক হতে পারেন। এ জন্য সফরসঙ্গীদের মোবাইল ফোন নিজে বন্ধ করে দেন। তাদের বলেন, ফোন খুললে তিনি কারও হাতে ধরা পড়তে পারেন।
নিজের ও সঙ্গীদের সব ফোন নিজের কাছেই রাখেন ত্ব-হা।
বিষণ্নতায় ভুগছিলেন তিনি
ত্ব-হা জবানবন্দিতে বলেন, তার ফিরে গিয়ে নিজেকে আড়াল করে রাখার পেছনে ‘ব্যক্তিগত কারণ’ ছিল। তার বেশ কিছু ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা ছিল। এ কারণেই সবার থেকে একটু আলাদা থাকার জন্য সিয়ামের বাসায় আশ্রয় নেন।
সেখানে গিয়ে ত্ব-হা অসুস্থতা বোধ করেন। ছিল করোনার উপসর্গও। ফলে তিনি একবারের জন্য ফোন খোলেননি।
আদালতকে জানিয়েছিলেন, যারা তার সঙ্গে ছিলেন, তারা তার খুব নিকটজন এবং বিশ্বস্ত। যে চালক গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তিনিও তার ঘনিষ্ঠ। এ কারণে তারাও তার কথা শুনেছেন।
শুক্রবার সুস্থ বোধ করলে দুপুর ১২টার দিকে রংপুরে প্রথম শ্বশুরের বাসায় এসে অবস্থান করেন এবং অন্যরা সবাই তাদের নিজ নিজ বাসায় চলে যান।
এই কয় দিন কী হয়েছে, জানতেন না
ত্ব-হা আদালতকে জানিয়েছেন, তিনি নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর তাকে নিয়ে যে এত সব হয়েছে, তা তিনি ধারণাও করতে পারেননি।
ফোন বন্ধ থাকায় অনলাইনে কী লেখালেখি হচ্ছে, তা তিনি ধারণা করতে পারেননি। টেলিভিশন থেকেও দূরে থাকায় বাইরের যে পরিবেশ ছিল তিনি বা তার সঙ্গীরা আঁচ করতে পারেননি।
এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথাও উল্লেখ করেন জবানবন্দিতে।
গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে অনীহা
রংপুর নগরীর সেন্ট্রাল রোডের আহলে হাদিস মসজিদসংলগ্ন মামার বাড়িতে শনিবার সকালে ত্ব-হার মা আজেদা বেগম ও মামা আমিনুল ইসলাম নিউজবাংলার সঙ্গে কথা বলেন।
আজেদা বেগম বলেন, ‘ও (ত্ব-হা) অসুস্থ, রাতে জ্বর এসেছে। সর্দিও আছে। এখন সে কারও সঙ্গে কথা বলবে না। সুস্থ হলে আমরা সবাইকে ডেকে কথা বলব।’
কী হয়েছিল ত্ব-হার, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছু জানি না। ও ভালো বলতে পারবে, সুস্থ হয়ে উঠুক। আমি এখন ছেলে পেয়েছি, এটাই বড় কথা।’
ত্ব-হার মামা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিষয়টি অবগত না। মিসিং ছিল, আমরা জিডি করেছি, উদ্ধার হয়েছে। আসলে কী ঘটেছে, সে নিজেই বলতে পারবে। এখন তো সে অসুস্থ, পাঁচ থেকে সাত দিন লাগবে সুস্থ হতে। এরপর আমরা সব মিডিয়াকে ডাকব। তখন সে তার কথা বলবে। কী হয়েছে কী হয়নি সেটা বলবে ত্ব-হা। একটু সময় দিতে হবে... ও সুস্থ হয়ে উঠুক।’