সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলা ও এনায়েতপুর থানার সদিয়াচাঁদপুর ইউনিয়নের যমুনা নদী থেকে ১৪-১৫ জনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র প্রকাশ্যে ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে এনায়েতপুরঘাটের পাশে স্তূপ করে রেখে ট্রাকযোগে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
ফলে শাহজাদপুর উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম, আরকান্দি, জালালপুর, পাকুরতলা ও পাচিল গ্রামের ৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যমুনা নদীর ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে।
ইতোমধ্যে এসব গ্রামের ৫০টি বাড়ি ও এক বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, চক্রটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন এনায়েতপুর থানার সদিয়াচাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম সিরাজ।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে অভিযোগ অস্বীকার করে রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘বালু উত্তোলনের সঙ্গে আমি জড়িত না। এখন ব্যস্ত আছি। পরে এ বিষয়ে কথা হবে।’
চৌহালীর বাসিন্দা আকবার মোল্লা জানান, বালু উত্তোলনের ফলে যমুনা নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে পশ্চিম পাড়ে স্রোত আঘাত হানছে। এতে এনায়েতপুর স্পার বাঁধ, খাজা ইউনুছ আলী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, খাজা ইউনুছ আলী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজাদপুর উপজেলার ব্রাহ্মণগ্রাম, আরকান্দি, জালালপুর, পাকুরতলা ও পাচিল গ্রামের ৬ কিলোমিটার এলাকা যমুনা নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে।
ধুলিয়াবাড়ির আশরাফ হোসেন পেশায় কৃষক। তিনি জানান, সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার সদিয়াচাঁদপুর ও স্থল ইউনিয়নের প্রভাবশালী ব্যক্তিসহ এনায়েতপুরের ১০-১৫ জনের একটি সংঘবদ্ধ চক্র গত ২৫-৩০ বছর ধরে যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে।
চক্রটি বছরে অন্তত ৬০-৭০ কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে থাকে। এতে সরকার প্রতিবছর বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে।
ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্জাক শেখ জানান, গত ১ সপ্তাহ ধরে এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের বহিস্কৃত সাধারণ সম্পাদক ও চৌহালী উপজেলার সদিয়াচাঁদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম সিরাজ, এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আহম্মদ মোস্তফা খান বাচ্চুর নেতৃত্বে একটি চক্র যমুনা নদী থেকে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে আসছেন।
সদিয়াচাঁদপুর ইউনিয়নের গাবেরপাড়া, উড়াপাড়া, মৌহালী, ইজারাপাড়াসহ আশপাশ এলাকার যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর এসব বালু স্তূপ করা হচ্ছে এনায়েতপুর ঘাটের উত্তর পাশে। পরে এখান থেকে ট্রাকে করে এনায়েতপুর, বেলকুচি ও শাহজাদপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বালু বিক্রি হচ্ছে।
গাবেরপাড়ার কৃষক মুল্লুক চাঁন জানান, যে সব স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তা ব্যক্তি মালিকানাধীন। শুষ্ক মৌসুমে এসব জায়গায় ফসল আবাদ করা হয়। সিরাজ চেয়ারম্যান ও তার লোকজন জোর করে সেখান থেকে বালু তুলছেন।
ব্রাহ্মণগ্রামের আজাহার আলী বলেন, ‘যমুনার নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে গেছি। কোথায় যাব, কি করব ভেবে পাচ্ছি না। যে কয়টি বাড়িঘর আছে তাও আর রক্ষা করা সম্ভব হবে না।’
এ বিষয়ে চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা ইয়াসমিন বলেন, ‘যমুনা নদীর চৌহালি অংশের কোথাও অনুমোদিত বালুমহাল নেই। তার পরেও বালু উত্তোলন ও বিক্রি থেমে নেই। খবর পেয়ে গত মঙ্গলবার এনায়েতপুর থানার ওসিকে বালু উত্তোলন ও বিক্রি বন্ধের নির্দেশ দিয়েছি। আজ আবারও ব্যবস্থা নিতে বলব।’
এনায়েতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান বলেন, ‘আমরা একাধিকবার বন্ধ করেছি। কিন্তু পুলিশ চলে আসার পরে আবারও তারা শুরু করে। এ জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা প্রয়োজন।’
সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহাম্মদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সিরাজগঞ্জ জেলার কোথাও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে দেয়া হবে না। চৌহালীর এনায়েতপুরে বালুদস্যুদের বিরুদ্ধে অল্প সময়ের মধ্যে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
এই বক্তব্যের তিন ঘন্টা পর এনায়েতপুরে যমুনায় ড্রেজার দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়ায় ৮ জনকে আটক করে ৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে এ অভিযান পরিচালনা করেন সিরাজগঞ্জের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদুর রহমান।
অর্থদণ্ড প্রাপ্তরা হলেন, এনায়েতপুরের সাদেকুল ইসলাম, আলাউদ্দিন, রঞ্জু মিয়া, খোকন, আব্দুল হামিদ, আব্দুল মতিন, আব্দুল আজিজ ও নুরন্নবী।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদুর রহমান জানান, এলাকাবাসী ও সাংবাদিকরা অভিযোগ করলে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে বৃহস্পতিবার বিকেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। ড্রেজারের মূল পরিচালনাকারীরা পালিয়ে গেলেও, তাদের ৮ সহযোগীদের আটক করে প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হয়। তারা মোট চার লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পান। সেই সঙ্গে আর কখনো এখান থেকে বালু উত্তোলন করবে না বলে মুসলেকা দেন।