নৌকা পারাপারে ছিলেন দক্ষ। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঠিক করেন নৌকায় যোদ্ধাদের পারাপার করিয়েই সাহায্য করবেন, যুদ্ধে অংশ নেবেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার নৌকায় করে ভারত যেতেন। ট্রেনিং শেষ করে ফিরেও আসতেন।
যুদ্ধের একপর্যায়ে নিজেও ট্রেনিং নেন মাঝি রাজ্জাক মিয়া। অংশ নেন সরাসরি যুদ্ধে। এর স্বীকৃতি হিসেবে ৯ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মেহেদী আলী ইমাম স্বাক্ষরিত প্রশিক্ষণ সনদও রয়েছে তার। ছিল মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিও। তবে চলতি বছর প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম নেই রাজ্জাকের।
রাজ্জাক মিয়া জানান, বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক কমান্ডারের রোষানলের শিকার হয়েছেন তিনি। এ কারণেই তালিকা থেকে নাম বাদ পড়েছে তার।
মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে রাজ্জাক মিয়া বলেন, ‘যুদ্ধের ট্রেনিং করতে যারা ওপার (ভারতে) যাইত, আমি হ্যাগো লইয়া যাইতাম, আবার ট্রেনিং কইরা যারা আইতো, তাগো এপার লইয়া আইতাম। মরণের চিন্তা হরি নাই মোডেও, সবাই ছইয়ের মধ্যে থাকলেও মোর বৈডা লইয়া বাইতে অইত।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দেয়া সাময়িক সনদতালিকা থেকে নাম বাদ পড়ায় মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বন্ধ হয়ে গেছে রাজ্জাকের। পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য এখন ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজ্জাক মাঝির সঙ্গে ছিলেন বরগুনার বামনা উপজেলার ৯ নম্বর সেক্টরের বুকাবুনিয়া সাব সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর কবির।
তিনি বলেন, ‘ভারতে ট্রেনিং নিতে আমরা রাজ্জাকের নৌকায় ওপারে গিয়েছি। দক্ষ মাঝি হওয়ায় তাকে আমরাই নৌকা চালানোর দায়িত্ব দিয়েছিলাম। ট্রেনিং শেষ করে ফেরার পর আমাদের সঙ্গে ও যুদ্ধেও অংশ নিয়েছে। তালিকা থেকে তাকে কেন বাদ দেয়া হয়েছে এই প্রশ্ন আমাদেরও।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন মোহন বলেন, ‘তালিকায় অনেকে আছে যারা যুদ্ধ করা তো দূরে থাক, প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেনি। অথচ তারা তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। রাজ্জাক মাঝির দুরবস্থা দেখে আমরা ব্যথিত।’
রাজ্জাক মাঝি জানান, একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার যেসব তথ্য-প্রমাণ দরকার তার সবই আছে।
মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টরের সাব সেক্টর কমান্ডার মেহেদী আলী ইমাম স্বাক্ষরিত প্রশিক্ষণের সনদে দেখা যায়, রাজ্জাক মাঝি ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ থেকে ১ নভেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এ ছাড়া ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে রাজ্জাক ৩০৩ রাইফেলসের সি-০৫৩৮৪ রাইফেল অস্ত্রটি তখনকার বরগুনা মহকুমার এসডিও সিরাজউদ্দীনের কাছে জমা দেন।
অস্ত্র জমা দেয়ার ৪৯২ নম্বর সনদেও তখনকার কমান্ডার মেহেদী আল ইমাম ও এসডিও সিরাজউদ্দীনের স্বাক্ষর রয়েছে।
রাজ্জাক জানান, এসব তথ্য-প্রমাণসহ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদনের পর ২০১৩ সালে ২৫৮ নম্বর গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা ০১০৪০০০০০৮৩ নম্বরে তালিকাভুক্ত হন তিনি।
২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল রাজ্জাক মাঝিকে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তার সনদ নম্বর ১৮৭৭২২। এরপর থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি সরকারের নিয়মিত ভাতা-সুবিধা ভোগ করে আসছিলেন।
বিতর্ক ওঠার পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর যাচাই-বাছাই কমিটি তাকে তালিকা থেকে বাদ দেয়ার সুপারিশ করে। ২০২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধাদের সংশোধিত তালিকায় নাম আসেনি রাজ্জাক মাঝির।
সদর উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদনে নাম আছে রাজ্জাক মাঝিরবরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি আবদুর রশীদ মিয়া বলেন, ‘উনি (রাজ্জাক) মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌকায় আমাদের পারাপার করেছেন। আমাদের সাথে ভারতেও গিয়েছেন। কিন্তু প্রশিক্ষণ বা যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন কি না, আমার জানা নেই। তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল হলে সেটা হয়তো নীতিমালা অনুযায়ী হয়েছে।’
২০১২ সালে এই রশীদ মিয়াই রাজ্জাক মাঝিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজ্জাকের কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও সাক্ষীপ্রমাণে গেজেটভুক্ত করে এবং ২০১৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদও প্রদান করে। কিন্ত ফের যাচাই-বাছাইয়ের পর ২০২১ সালে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম নেই রাজ্জাকের, আছে নামঞ্জুরকৃতদের তালিকায়।
রাজ্জাক মাঝি জানান, তার কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার আবদুর রশীদ মিয়া প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে কমান্ড কাউন্সিলের নির্বাচনে তিনি রশীদের বিরোধী প্যানেলের হয়ে কাজ করেন। এ কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে সুকৌশলে বাদ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রাজ্জাকের।
তিনি বলেন, ‘নিজের জীবন বাজি রাইখ্যা মুই নৌকার মাঝি হইয়া কাম করছি। প্রশিক্ষণ শেষে তাফালবাড়িতে যুদ্ধ করছি। মোর কাগজপত্র দেইখা প্রথমে সনদ আর ভাতা সুবিধা পাইছিলাম। কমান্ড কাউন্সিলের দলাদলির শিকার আমি।’
বরগুনা সদর উপজেলার ফুলঝুড়ি ইউনিয়নের ছোট গৌরিচন্না গ্রামে রাজ্জাক মাঝির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, থাকার জায়গা বলতে আধভাঙা দোচালা টিনের একখানি ঘর। বারান্দার টিন নষ্ট হয়েছে কবেই, নতুন করে কেনার সাধ্য নেই। বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষা পেতে পলিথিন দিয়ে রেখেছেন বারান্দার চালায়।
একমাত্র ছেলে পেশায় রিকশাচালক। মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু বছর কয়েক পর উধাও হয়েছেন জামাই। মেয়ে, নিজেরা দুইজন, বড় ছেলের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আট সদস্যের পরিবার।
ছেলের সামান্য আয়ে সংসার চলে না। বৃদ্ধ বয়সে শরীরে আর শক্তি নেই শক্ত হাতে নৌকার হাল ধরার। জীবিকার তাগিদে তাই পথে নেমেছেন।
রাজ্জাকের এমন দুরবস্থার বিষয়ে বরগুনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের সাবেক সভাপতি আবদুর রশীদ মিয়া বলেন, ‘তিনি এখন যদি ভিক্ষা করে খান, তাতে আমাদের কী?’
রাজ্জাক মাঝির প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র জমা দেয়ার সনদ জাল দাবি করে রশীদ মিয়া বলেন, ‘যারা রাজ্জাক মাঝিকে সুপারিশ করেছিল তারা বৈধভাবে করেনি।’
২০১২ সালে রাজ্জাক মাঝিকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়নপত্র দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গেজেটভুক্ত হওয়ার পরই আমি তাকে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছিলাম।’
দলাদলীর কারণে বাদ দেয়ার অভিযোগের বিষয়ে আবদুর রশিদ বলেন, ‘নির্বাচন গোপন ভোটে হয়। রাজ্জাক কারে ভোট দিছে, সে নিজেই জানে।’
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়লে তিনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আপিল করতে পারেন। মন্ত্রণালয় তাকে ফের স্বীকৃতি দিলে আমরা যোগ্য সম্মান ও যথাযথ সুবিধা বুঝিয়ে দেব।’