পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেশব্যাপী গ্রামীণ রাস্তার দুই পাশে তালগাছের চারা রোপণের জন্য ২০১৭ সালে নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্দেশনা অনুযায়ী ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ নেয়।
চারা রোপণের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ দেয়া না হলেও অর্থ খরচ হচ্ছে কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্প থেকে। এর আওতায় রংপুরের আট উপজেলার ছয়টিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে তালগাছের চারা রোপণ করা হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬৭টি।
এর মধ্যে মিঠাপুকুর উপজেলায় ৫১ হাজার, পীরগাছা উপজেলায় ২৩ হাজার, তারাগঞ্জ উপজেলায় ১ হাজার ৬৫০, গংগাচড়া উপজেলায় চার হাজার এবং পীরগঞ্জ উপজেলায় ১৫ হাজার ৫০০টি তালগাছের চারা রোপণ করা হয়। রংপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার অফিস বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
তবে রংপুরে এতসংখ্যক তালের চারা রোপণ করার কথা বলা হলেও বাস্তবে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। অযত্ন-অবহেলায় এসব গাছ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
মিঠাপুকুর উপজেলার ভাংনী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, ‘পায়রাবন্দের বেগম রোকেয়ার স্মৃতিকেন্দ্রে যাওয়ার পথের সড়কে যে চারাগুলো লাগাইছিলাম, তা দুই-চারটা হয়তো আছে। সেগুলো দেখতে পাবেন। তবে যত্নের অভাবে বাকি গাছগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।’
পীরগঞ্জের চৈত্রকোল ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের অনন্তরামপুর নয়াপাড়া গ্রামের একটি সড়কে কিছু তালের চারা রোপণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো নাই। পাশের জমির মালিকরা তুলে ফেলছে। জমির ক্ষতি হয় এ জন্যই জমির মালিকরা গাছগুলো রাখেনি।’
বদরগঞ্জের গোপীনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘তালগাছ তো আমার চোখে পড়ে না। কোন এলাকায় লাগানো হয়েছে, তা-ও জানি না। খোঁজ নিতে হবে।’
একই অবস্থা পীরগাছা, তারাগঞ্জ ও গংগাচড়া উপজেলাতেও। গাছের হিসাব খাতায় থাকলেও সড়কে বাস্তবে এর কোনো মিল নেই।
রংপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবু তাহের মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে তালগাছ লাগানোর। সে ক্ষেত্রে আমাদের বলা হয়েছে কৃষি বিভাগের পরামর্শে গাছ লাগাতে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমরা যেসব গাছ লাগিয়েছি, তা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা চলতি অর্থবছরেও (২০২০-২১) তালগাছ ও বীজ রোপণ করেছি। অনেক জায়গায় রোপণ করা গাছগুলো নষ্ট হয়েছে এটা ঠিক। এগুলো রক্ষায় আমাদের অফিসার, স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের আরও যত্নশীল হতে হবে। তাহলেই এগুলো রক্ষা পাবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু রংপুর জেলা নয়, বিভাগের বাকি আট জেলারও একই অবস্থা। গাছ বা বীজ রোপণ করেই দায়িত্ব শেষ হয়েছে, রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। ফলে অস্তিত্ব নেই এসব তালগাছের।
গাইবান্ধায় প্রতি ইউনিয়নে এক লাখ তালের চারা
গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা একেএম ইদ্রিশ আলী জানান, ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধা জেলার তিন পৌরসভা ও সাত উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়নে এক লাখ তালের চারা রোপণ করা হয়।
এর মধ্যে গাইবান্ধা পৌরসভা এলাকায় ৯ হাজার, গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভায় ৩ হাজার ও সুন্দরগঞ্জ পৌরসভায় ২ হাজার এবং বাকি ইউনিয়নগুলোতে ১ হাজার ১০০টি করে তালের চারা ও বীজ রোপণ করা হয়।
একেএম ইদ্রিশ আলী জানান, ওই বছরের পর আর নতুন করে গাছ বা বীজ রোপণ করা হয়নি।
তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু তালগাছ হচ্ছে। তবে সবগুলো টিকে নাই। সবগুলো টিকার আশাও করছি না। গরু-ছাগলে কিছু খেয়ে ফেলেছে। ফিফটি পারসেন্টও যদি টিকে যায়, তাতেই আলহামদুলিল্লাহ।’
সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউপি সদস্য নুরুন্নবী আকন্দ বলেন, ‘আমি নিজেও অনেক তালের আঁটি পুঁতেছিলাম। কিন্তু একটাও টেকে নাই। আমার জানামতে, ইউনিয়নের কোনো রাস্তায় এক সারিবদ্ধ কোনো তাল গাছ নাই। চোখেও পড়েনি কোনো দিন।’
এদিকে, কী পরিমাণ চারা গাছ দৃশ্যমান রয়েছে এর সঠিক তথ্য দিতে পারেননি জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা।
নীলফামারীতে ৭২ হাজার তালের চারা
নীলফামারী জেলায় গত দুই অর্থবছরে ৭২ হাজার ১১০টি তালের চারা রোপণ করা হয়।
এর মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪৪ হাজার ১০টি এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৮ হাজার ১০০টি চারা রোপণ করা হয়।
উপজেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন দপ্তর এবং ইউনিয়ন পরিষদ এসব চারার রক্ষণাবেক্ষণ করছে।
তবে মাঠপর্যায়ে পরিচর্যার অভাবে নষ্ট হতে বসেছে সেগুলো। কোথায় রোপণ করা হয়েছে, সেটিরও নিশ্চয়তা নেই। নেই চিহ্নিতকরণ ব্যবস্থাও।
জেলার সদর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রিয়াজুল ইসলাম জানান, গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচির আওতায় দুই অর্থবছরে ২৩ হাজার ৮৬০টি তালের বীজ বপন করা হয়েছে। এই অর্থবছরেও বীজ বপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এলিনা আকতার বলেন, ‘কোথাও কোথাও তালের বীজ নষ্ট হয়েছে। কোথাও ঠিক রয়েছে।’
উপজেলা প্রশাসন ছাড়াও পিআইও এবং ইউনিয়ন পরিষদ রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা এই তালবীজগুলো।
ঠাকুরগাঁওয়ে ফাঁকা পড়ে রয়েছে রাস্তার ধার
২০১৭ সালের ৪ অক্টোবর ঠাকুরগাঁওয়ের ৭০ হাজার তালবীজ বপন অভিযান শুরু হয়।
সদর উপজেলার আকচা ইউনিয়নে লাগানো সেই ১৫ হাজার তালের বীজের কোনোটিই গাছ হয়নি, ফাঁকা পড়ে রয়েছে রাস্তার ধার।
আকচা ইউপি চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার বর্মন বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চৌরঙ্গী বাজার যাওয়ার রাস্তায় ১৫ হাজার তালবীজ বপন করা হয়েছিল। কিন্তু পরে ইটভাটার মহেন্দ্র গাড়ি যাওয়ার কারণে গাছগুলো গজিয়ে উঠতে পারেনি। কয়েকটা গাছ গজালেও স্থানীয় কিছু মানুষ সেই চারাগুলো নষ্ট করে ফেলে।’
ঠাকুরগাঁওয়ের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সহকারী কমিশনার শামছুজ্জামান আসিফ বলেন, ‘জেলার পাঁচটি উপজেলায় মোট ৭০ হাজার তালবীজ বপন করার কথা ছিল ২০১৭ সালে। তখন এই বীজ বপন শুরু করে কৃষি বিভাগ। আকচা ইউনিয়নে ১৫ হাজার চারা বপন করলেও সেই জায়গায় কোনো গাছের দেখা মেলেনি। এখন আমরা জেলাসহ বিভিন্ন উপজেলায় গাছ লাগানোর পরিকল্পনা করছি।’
বাকি উপজেলার বীজগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোথাও তালগাছ এখনও চোখে পড়েনি। আমরা দেখব বিষয়টি।’
গরু-ছাগলে খেয়েছে লালমনিরহাটের তালগাছ
লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলায় ২২ হাজার ৫০০ তালের চারা লাগানো হয়েছে। এর মধ্যে লালমনিরহাট সদরে পাঁচ হাজার, কালীগঞ্জে আড়াই হাজার, আদিতমারীতে পাঁচ হাজার, হাতীবান্ধায় পাঁচ হাজার এবং পাটগ্রামে পাঁচ হাজার।
স্থানীয় প্রশাসন এই গাছগুলো ভালো আছে দাবি করলেও বাস্তবে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
সদর উপজেলার হারাটি ইউপি চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ৫০টি তালের চারা লাগাইছিলাম, কিন্তু তার একটাও নাই। গরু ছাগল খেয়ে শেষ করছে।’
কালীগঞ্জের তুষভাণ্ডার ইউপি চেয়ারম্যান নুর ইসলাম বলেন, ‘তালের বীজ লাগাইছিলাম, কিন্তু এখন পর্যন্ত গাছ হয় নাই। তবে তাল গাছের বীজ থেকে চারা গজাতে দুই থেকে চার বছর লাগে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না কী হবে।’
লালমনিরহাট সদরের ইউএনও উত্তম কুমার বলেন, ‘তালগাছের চারা ও বীজ উভয়ই লাগানো হয়েছে। কিন্তু বীজগুলো এখনও গজায়নি। চারাগুলো কি অবস্থায় আছে সেটি আমি ঠিক বলতে পারব না।’
রংপুর বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) জাকির হোসেন বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনকে দিয়ে রোপণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেক জায়গায় কিছু গাছ দৃশ্যমান আছে আবার কোথাও নেই। এগুলো কীভাবে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে আমরা পরামর্শ করব এবং নির্দেশনা দিব।’