বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভাঙনের কবলে তিস্তা নদী

  •    
  • ৯ জুন, ২০২১ ২২:৩২

তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘বুধবার হঠাৎ তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ বেড়েছে। উজানের ঢেউ ও বৃষ্টিপাতে এমনটি হয়েছে। যে অবস্থা দেখছি তাতে পানি আরও বাড়তে পারে।’

লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বাড়তে শুরু করেছে। ভারী বৃষ্টি আর উজানের পাহাড়ি ঢলে বেড়েছে তিস্তার পানিপ্রবাহ।

বুধবার সকাল ৯টায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানিপ্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫২ দশমিক ৫১। অর্থাৎ বিপৎসীমার মাত্র ৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তলদেশ ভরাট হয়ে তিস্তা নদীর দুই পাড়ের চরাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে ভাঙতে শুরু করেছে সমতল এলাকাগুলো। এরই মধ্যে চরাঞ্চলের ভুট্টা, বাদাম, মিষ্টি কুমড়াসহ নানান সবজির ফসল ডুবে গেছে।

তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘বুধবার হঠাৎ তিস্তা নদীর পানিপ্রবাহ বেড়েছে। উজানের ঢেউ ও বৃষ্টিপাতে এমনটি হয়েছে। যে অবস্থা দেখছি তাতে পানি আরও বাড়তে পারে।’

স্থানীয়রা জানান, উজানের পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের বৃষ্টিতে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে শুকিয়ে যাওয়া তিস্তা আবারও যৌবন ফিরে পেয়েছে। জেলার পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম; হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী; কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা; আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা, পলাশী ও সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, ইউনিয়নে তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার পরিবারের পানিবন্দি হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তবে হঠাৎ তিস্তায় পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় সৃষ্ট বন্যায় চরাঞ্চলের সবজি, বাদাম ও ভুট্টাসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবকিছু পানিতে ডুবে গেছে। আর ভাঙতে শুরু করেছে নিম্নাঞ্চলগুলো। এ কারণে চিন্তিত তিস্তাপাড়ের মানুষরা। পানিবন্দি পরিবারগুলো শিশু, বৃদ্ধ ও গবাদি পশুপাখি নিয়ে পড়েছে বিপাকে। তারা তাদের বাড়িঘর নিয়ে যাচ্ছে দূরের কোনো এক অজানা বাঁশঝাড়ে । অনেকে ঠাঁই নিচ্ছেন অন্যের বাড়িতে। তিস্তাপাড়ের ফাতেমা আহাজারি করে বলেন, ‘হামাক বাঁচান ব্যাড়ে, হামার শোগ শ্যাষ। সব নদীত ভাঙ্গিয়া গেইছে ব্যাড়ে। হামাক বাঁচান। হামরা কৈ যাম কি খামা করি করম শোগ নদী ভাঙি নিয়া যাবার লাগছে। সরকার এগুলা কি কইরবার লাগছে। হামাক বাঁচান ব্যাড়ে, হামা বাঁচান।’

তিস্তাপাড়ের বালাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সজল বলন, ‘হামার বাড়ি ভাঙ্গি যাবার লাগছে তাই যাতে নদীর পানি ভুঁই বাঠিত না যায় তার জন্য আইল দিবার লাগছি। নদী ত কয়েকবার ভাঙ্গচে। সব তো শেষ। এখন আইল কি আর টিকে। তাপ দেই।’

তিস্তাপাড়ের শিক্ষার্থী আবু সায়েম বলেন, ‘তিস্তা নদীর কাজ কিছুতেই হচ্ছে না। সবাই আশা দেয় কিছু করতেছে না। আজ নদীর পানি বাড়তেছে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি নিয়ে কই যাব আমরা। এই যে দেখেন নদী ভাঙতে ভাঙতে আমাদের বাড়ির পাশে এসেছে। কই যাব আমরা। সবাই শুধু সান্ত্বনা দেয়। আমাদের জায়গা জমি ত সব নদীতে চলে গেছে। কি করব আমরা?’

হাসান আলী বলেন, ‘নদীর মাঝখানে আমার বাড়ি ছিল। বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে আজ যেখানে বাড়ি দেখতেছেন তার পাশ পর্যন্ত ভাঙন আসছে। আমার বাড়িটা যেকোনো সময় ভাঙতে পারে। কাচারত আসছে ভাঙন। শুধু প্রশাসন আমাদেক সান্ত্বনা দেয়। যদি শুকনো মৌসুমে বালুর বস্তা দিত তা হলে আর ভাঙত না। গতবারের মতন আজ আবার পানি বাড়তে শুরু করেছে। আমরা কই যাব, যাওয়ার তো জায়গা নাই।’

তিস্তাপাড়ের দুলাল মিয়া (৫৫) বলেন, ‘আমরা রিলিপ-টিলিপ কিছু চাই না। বালুর বান্ধ থাকি শুরু করি নদীর পাশে যদি বস্তা দিত তাহল আর নদী ভাঙত না।’ আমরা বালুর বান্দ চান্দা কালেকশন করিয়া বান্দিছি। ডিসি মহোদয় আসিয়া কইছে আমি বস্তা দিব। কিন্তু কোনো বস্তা দেয়নি। সব ভাঙি যাবার লাগছে। আমরা নিজেরা উদ্যোগ নিয়া বালুর বাধ দিবার লাগছি। কিন্তু বাধ দেয়া শেষ কোনো মন্ত্রী এমপি আসল না। বালুর বান্দ থাকি পুরা ৪ ও ৫ নম্বর ওয়াড নদী ভাঙবার লাগছে। কিন্তু কাও খোঁজ করে না। কাও ভাল করে না। বারবার নদী ভাঙ্গে খালি দেখি যায় কিন্তু ভালো করার কোন অ্যাকশন নেয় না। থাইকপার জায়গা নাই, জমি নাই সব ভাঙি নিয়া গেইছে তিস্তা।’

তিস্তাপাড়ের মহিষখোচা বালাপাড়ার রজব পাড়ার আব্দুল হাসিব (৬০) বলেন, ‘আজ পানি বাড়তেছে। আমাদের বাড়িঘর থাকে না। খালি ভাঙি যায়। আমাদের জমি নাই জায়গা নাই। আমরা যাব কোথায়। আমাদের যাবার স্থান নাই। নদীতে যদি কিছু বস্তা দেয়া যায়, তাহলে নদীটা টিকসই হবে আর ভাঙনটাও কমবে।’

শোভা বলেন, ‘আমাদের ভুট্টাবাড়ী ৪ দোন মাটি আবাদ কচ্চি। খুব কষ্ট করি। বাড়ি পাকা করছি তায়ও শোগ ভাঙ্গি যাবার নাগছে। তোমরা বোল্ডার ফেলে দেও। তা হলে ভাল হবে। ৫০০ টাকার জন্য কি ভোট দেই তোমাক। হামার শরম লজ্জা থুইয়া হামরা ভোট দেই। বয়স্ক দেন, বিদুয়া দেন, আরও বাউরা হবে। আর খ্যায় লোব বাড়ি যাইবে। ওগলা বেবাক বন্দ করি দেন। ওই টাকা দেয়া বন্দ করি দেন। ওই টাকা দিয়া তোমরা বস্তা দেও বোল্ডার ফেলান। মানুষের জাহান বন্ধ হয়া যাবার লাগছে কাবিল হয়া। কিসের না চিড়া গুর ধরি আইসেনি। চিনি গুর খ্যায়া মাইনসে হাবরে আরও বেশি হয়া যায়। আরও বাউরা হয়্যা যায়। আমি যদি শেখ হাসিনা হনু হয় তাইলে এই দুনিয়া ঠাণ্ডা করি দিলাম হয়।’

ফরিদা বলেন, ‘হামরা রাস্তার মুরিত বাড়ি করি আছি। এখন সেটে পানি ভরা হবার নাগছে। হামরা কোটে যেয়া থাকম কোটে যেয়া খামো তার কোন ভইয়াকার নাই। ৪ মাসে ৬ মাসে কি এক না দেয় ওমাকে না আটে।’

মর্জিনা বলেন, ‘কি করম কোনো বুদ্ধি নাই। আমার যে কোনো বাস্তবে টাকা পয়সা তা নাই। হাতে করি পেটে খাই। এই বাস্তটা একনা তাও ভাঙ্গি যাবার লাগছে। এই যে বাইরে পাক কইরবার লাগছি। সরকার একটা ঘর দিছে তাও ভাঙি যাবার লাগছে। বাল বাচ্চা নিয়া কি করম। দুইটা ঘর তারও একটা রাস্তাত থুয়া আছি। আমি করি খাইতে পাই না দেখি সরকার আমাক ঘর দিছে। মানুষের ঋণও এখন শোধ কইরবার পাই নাই ফির ভাঙিবার লাগছে। সামনে বস্তা ফেলা চলো ভাঙে নাই। এখন বস্তাগুলো পানিত গেছে তাই ভাঙিবার লাগছে। এই মুহূর্তে যদি বস্তা ফেলায় তাহলে একনা নিন পাইরবার পামো। না হলে শোগ রাইতোতে ধুয়া নিয়া যাবে নদী।’

বালাপাড়ার মোহাম্মদ আলী (৬০) বলেন, ‘তেরো বার বাড়ি ভাঙছে। বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে ওপার থাকি মহিষখোচা পর্যন্ত আসিয়া গেছি। মহিষখোচা আসিয়াও আমরা পানি টানি বাঙ্গরি টাংরি হায় হুলাচতুল। এই গরু বাচুর মানুষ আমরা অসহায় যাব কোথায়। কোথায় খাব। ৫০ বছর থাকি শুনবার লাগছি নদী খনন হবে। খননও নাই কোন নদীর ব্যবস্থাও নাই। কি আমার সরকার কি কইরবার লাগছে। আমরা যাব কোথায়? বাড়িঘর সব ভাসি যাবার লাগছে। এ যে ভূট্টা ৪ দোন ৫ দোন সব ভাসি যাবার লাগছে। কোথায় যাবার মতো জায়গা নাই।’

লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা বাঁধ নির্মাণের জন্য বাজেটের আবেদন করেছি, কিন্তু এখন পর্যান্ত বাজেট পাইনি। কিছু বস্তা ফেলা হয়েছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। নদীর পানি বাড়ছে এবং বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ভাঙনও বাড়ছে। আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে করে ভাঙন রোধ করা যায়।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর বলেন, ‘আজ পানি বাড়ছে কি না তা বলতে পারছি না। তবে একটা মিটিং আছে, শেষ হলেই আমি সেখানে যাব। আর তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা করা লাগলেও করা হবে। যদি বস্তা হলে ভাঙন রোধ হয়, তা হলে আমরা সেই ব্যবস্থাও করব। আর পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পর্যাপ্ত খাবার মজুত আছে, ভাঙনকবলিত এলাকায় দ্রুত সেসব বিতরণ করা হবে।’

এ বিভাগের আরো খবর