মাদক ব্যবসা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়াতে ফরিদপুরের মধুখালীর মাকড়াইল গ্রামের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জাহাঙ্গীরের বাবা হারুনুর রশীদ হিরু মিয়া ৬ জুন রাতে মধুখালী থানায় একটি মামলা করেছেন।
হত্যায় অংশ নেয়া ওয়ালিদ হাসান মামুনকে প্রধান আসামি করে ১৬ জনের নামে ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১০-১৫ জনকে আসামি করে ওই মামলা করা হয়।
৫ জুন দুপুরে মধুখালী বাজার থেকে ভ্যানে করে বাড়ি ফেরার পথে মাকরাইল গ্রামের উত্তর পাড়া এলাকায় রাস্তায় মামুন ও তার লোকজন জাহাঙ্গীরের উপর হামলা চালায়। এ সময় তাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে মৃত ভেবে ফেলে যায় হামলাকারীরা।
পরে গ্রামের লোকজন জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে মধুখালী হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে তার শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে সন্ধ্যায় ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাত দেড়টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান জাহাঙ্গীর হোসেন।
নিহত জাহাঙ্গীর হোসেনের ফুফাতো ভাই মনিরুজ্জামান বলেন, ‘জাহাঙ্গীর ঢাকাতেই বসবাস করতেন। করোনার কারণে রোজার শুরুতে জাহাঙ্গীর মধুখালীতে চলে আসেন। তিনি মধুখালী বাজারে পার্টসের ব্যবসা শুরু করেন।
‘এলাকায় এসে দেখেন পুরো এলাকা মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীর খোঁজ নিয়ে দেখেন এসব অপকর্মের পেছনে রয়েছে ওয়ালিদ হাসান মামুন। মামুনের বিভিন্ন অপকর্মে বাধা দেয়ায় জাহাঙ্গীরের ওপর ক্ষিপ্ত হয় মামুন। একারণেই তাকে পিটিয়ে হত্যা করে মামুন ও তার লোকজন।’
নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা হারুনুর রশীদ বলেন, ‘জাহাঙ্গীর খুব নরম প্রকৃতির ছেলে। কারও সঙ্গে ঝামেলা করত না। কিন্তু সে প্রতিবাদী ছিল।
‘এলাকায় মামুনের অপকর্মের প্রতিবাদ করায় সে আমার ছেলেকে নির্মমভাবে মেরে ফেলেছে। মামুনকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তির ব্যবস্থা না করলে আরও অনেক পিতার বুক খালি হয়ে যাবে।’
কামালদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান হাবিবুল বাশার বলেন, ‘মামুন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। মাদক ব্যবসা ও নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত তিনি। জাহাঙ্গীরকে নির্মমভাবে হত্যার আগেও এলাকায় একাধিক অপকর্ম করেছেন তিনি। মামুন ও তার বাহিনীর অত্যাচারে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।’
‘কয়েকদিন আগে ছোরাফ হোসেন, রেজাউল শেখ ও বিল্লাল হোসেনের বাড়িতে হামলা চালায় মামুন ও তার লোকজন। এ সময় তাদের মারপিট ও বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুর করে তারা। নয়াবাড়ী এলাকার রবিউলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার খড়ের পালায় আগুন ধরিয়ে দেয়।’
ইউপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পারুল নামে একটি মেয়েকে জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে মারপিট করে। এসব ঘটনা ঘটালেও ভয়ে তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে না। প্রতিবাদ করলেই তার ওপর চলে অমানসিক নির্যাতন চালায়।
‘জাহাঙ্গীরকে হত্যার আগের দিন তারা মেছোড়দিয়ায় মামুন তার ভগ্নিপতির বাড়িতে বসে গোপন বৈঠক করে। এরপর তারা পরিকল্পিতভাবে জাহাঙ্গীরকে হত্যা করে।
‘এর আগে এই মামুন ঢাকায় ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে জেলও খেটেছে। র্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছে। এখনো সে এলাকায় তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে এসব অঘটন ঘটিয়ে চলেছে।’
মাকড়াইল গ্রামের বাসিন্দা আফসার শেখ বলেন, ‘জাহাঙ্গীর একজন উচ্চ শিক্ষিত ভদ্র ছেলে। সে এলাকায় আসার পর এসব অপকর্ম দেখে প্রতিবাদ করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করলো মামুন ও তার লোকজন।’
মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা মামুনকে প্রধান আসামি করে মামলা করেছেন। আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে।’
এদিকে জাহাঙ্গীরকে হত্যার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসী। হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে গ্রামবাসী। তারা দ্রুত হত্যাকাণ্ডে জড়িত মামুন ও তার সহযোগীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছে।
কে এই ওয়ালিদ হাসান মামুন
ওয়ালিদ হাসান মামুনের বাড়ি মধুখালী উপজেলার মাকড়াইল গ্রামে। দীর্ঘদিন ঢাকায় বসবাস করার পর ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটে গ্রামে ফিরেছেন।
আগে র্যাবের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারও হয়েছে। সে মামলাতেও কারাভোগ করেন মামুন। পরে নিজ এলাকা মাকড়াইলে চলে আসেন মামুন। এলাকায় গড়ে তোলেন নিজস্ব একটি ক্যাডার বাহিনী।
তিনি ও তার বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় মাদকের ব্যবসা শুরু করেন। এ ছাড়া নারী পাচারের সঙ্গেও জড়িত হন মামুন।
মামুনের বিরুদ্ধে মধুখালী থানায় একাধিক অভিযোগ দেয়া হয়েছে বলে এলাকাবাসী জানায়।
জাহাঙ্গীর হোসেন
মধুখালী উপজেলার কামালদিয়া ইউনিয়নের মাকরাইল গ্রামের হারুনুর রশীদ হিরু মিয়ার বড় ছেলে জাহাঙ্গীর হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষে দীর্ঘদিন ঢাকাতেই মোটর পার্টসের ব্যবসা করতেন। তবে করোনা মহামারির কারণে ঢাকা থেকে নিজ গ্রাম মাকরাইলে ফিরে মধুখালী বাজারে পার্টসের ব্যবসা শুরু করেন।
জাহাঙ্গীরের স্ত্রী চার বছর আগে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার দুই মেয়ে ও একটি চার বছরের ছেলে রয়েছে।