ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসরাত জাহান তুষ্টিকে চোখের জলে শেষ বিদায় জানিয়েছেন তার মা, বাবা, পরিবার, স্বজনসহ এলাকাবাসী।
সোমবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার নীলকণ্ঠপুরের গ্রামের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়েছে।
- আরও পড়ুন: আজিমপুর কোয়ার্টারে নিথর ঢাবি ছাত্রী
এর আগে সকাল ৯টার দিকে সুখারী ইউনিয়নের ঈদগাহ মাঠে জানাজা হয়৷
জানাজায় সুখারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন খোকনসহ এলাকার শ শ মানুষ অংশ নেন।
রোববার রাত সোয়া ১০টার দিকে তুষ্টির মরদেহবাহী গাড়িটি নীলকণ্ঠপুরের বাড়িতে এসে পৌঁছায়। মরদেহ আসার খবরে এলাকার মানুষও ছুটে যান বাড়িটিতে।
রাজধানীর আজিমপুর সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারের একটি ভবনের টয়লেট থেকে রোববার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ইসরাত জাহান তুষ্টির মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিস।
তুষ্টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। করোনার কারণে হল বন্ধ থাকায় তিনি আজিমপুর সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে সাবলেটে থাকতেন।
যেভাবে উদ্ধার হয় মরদেহ
রোববার ভোর ছয়টার দিকে পলাশী আবাসিক কোয়ার্টারের ১৮ নম্বর বাসার নিচ তলার একটি রুমের বাথরুমের দরজা ভেঙে তুষ্টির মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। তুষ্টি যে বাসায় সাবলেট থাকতেন সে বাসায় তিনটি রুম। এর একটি রুমে আরও তিনজনের সঙ্গে থাকতেন তিনি। বাথরুমটি ছিল রুমের বাইরে।
তুষ্টির সহপাঠী রাহনুমা তাবাসসুম রাফির সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। তিনি বলেন, ‘গতকাল দুপুরে তুষ্টি তোশক আনতে হলে (বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল) গিয়েছিল। রুম থেকে নেয়া তোশক হলের গেস্টরুমে রেখে কালো ক্লিপ এবং বেল্ট আনতে আমাকে নিয়ে সে নিউ মার্কেট নিয়ে যায়। সেসময় বৃষ্টি পড়ছিল। সাথে ছাতা না থাকাতে বৃষ্টির পানি পড়েছিল তার শরীরে।
‘তুষ্টির আগে থেকেই অ্যাজমা এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা। সে ইনহেলার ব্যবহার করতো। বৃষ্টিতে ভিজলে নাকি এগুলো বেড়ে যায়। তুষ্টি তখন আমাকে বলেছে, রাফি আমার মনে হয় রাতে শরীর খারাপ করবে।’
তার আরেক রুমমেট রাহনুমা বলেন, ‘নিউ মার্কেটের কাজ শেষে হলের গেস্টরুমে রাখা তোশক নিয়ে বিকেল তিনটার দিকে আমরা বাসায় চলে আসি। বিকেল পাঁচটার দিকে আমি ক্যাম্পাসে যাই। যাওয়ার সময় তুষ্টিকেও ডেকেছিলাম। তার শরীর খারাপ লাগছে তাই সে আমার সাথে যায়নি। রাত নয়টার দিকে আমি ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরে আসি। ক্যাম্পাস থেকে আসায় আমিও ক্লান্ত ছিলাম। খাওয়া শেষে ১০টার দিকে শুয়ে পড়ি। বারোটার দিকে ঘুমিয়ে যাই। সেও (তুষ্টি) আমার সাথে শুয়েছিল। তখন সে হয় মুভি দেখছিল, না হয় ফেসবুকে স্ক্রল করছিল। এরপর আর কী হয়েছে আমি জানি না।’
রাহনুমা আরও বলেন, ‘ভোর ছয়টার দিকে সাবলেটের আন্টি এসে বলেন, তোমরা সবাই রুমে তাহলে ওয়াশরুমে কে। পানি পড়ছে, লাইট জ্বালানো। পরে ইতি আপু (আরেক রুম মেট) দেখে, তুষ্টি নেই। অনেকক্ষণ বাথরুমের দরজায় নক করছে। কিন্তু ভিতর থেকে কোন শব্দ নেই৷ আমি দেখি তুষ্টির ফোন তার বেডেই। পরে ঘটনাটা আমি তুষ্টির আব্বুকে জানাই। এরপর আমি আমাদের বন্ধু সাফায়াত আহমেদ রাজুকে ফোন দেয়। সে এসে ভেন্টিলেটর দিয়ে দেখে ভিতরে কারো পা দেখা যাচ্ছে। তারপর সে ৯৯৯ ফোন দেয়। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কয়েকজন এসে তার মরদেহ নিয়ে যায়।’
তুষ্টির রুমমেট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লুৎফুন্নাহার ইতি বলেন, ‘তুষ্টি মাত্র পাঁচ দিন আগে আমাদের বাসায় আসে। গতকাল বিকেল তিনটায় নিউমার্কেট থেকে এসে বলে, “আপু তোমরা কীভাবে বৃষ্টিতে ভেজো। আমি একটু ভেজার পর গলা চুলকাচ্ছে”। এর আগে আমি জানতাম না তার অ্যাজমা আছে।’
রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, 'রাতে আমরা আড্ডা দিয়ে, হাসি, ঠাট্টা করে ঘুমিয়ে যাই। দুইটা বাজে আমি ঘুম থেকে উঠে কয়েকবার বাথরুমের দরজায় নক করি। কিন্তু তখন দরজা খুলেনি। তবে আমি কলের পানি পড়ার শব্দ পাচ্ছিলাম। বাড়িওয়ালা মনে করে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ভোর ৬টায় বাড়ির মালিকের ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাঙে। বাড়ির মালিক বলেন, “বাথরুমে কলের পানি পড়ছে ভেতরে কে?” তখন আমরা তাকিয়ে দেখি তুষ্টি বিছানায় নেই।’
সুরতহাল রিপোর্ট
তুষ্টির সুরতহাল রিপোর্ট নিউজবাংলার হাতে এসেছে। রিপোর্টে দেখা যায়, বাথরুম থেকে উদ্ধার করে যখন তুষ্টির দেহ মর্গে আনা হয় তখন তার পরনে ছিল লাল হাফ হাতা গেঞ্জি এবং নেভি ব্লু রঙের ট্রাউজার। চোখ-মুখ ছিল অর্ধ খোলা অবস্থায়, জিহ্বা দাঁত দিয়ে সামান্য কামড়ানো। বুক, পেট, পিঠ, কোমর হতে পা পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। হাত দুটি ছিল অর্ধমুষ্টি অবস্থায়। বাম হাতের কনুই এবং পিঠের বাম পাশে পুরাতন দাগ ছিল।
ময়নাতদন্ত শেষে ঢাকা মেডিক্যালের মর্গ থেকে তুষ্টির মরদেহ বিকেল তিনটার দিকে নিজ বাড়ি নেত্রকোনার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে তুষ্টির নামাজে জানাজা হওয়ার কথা থাকলেও বৈরি আবহাওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
লালবাগ থানার ওসি (তদন্ত) খন্দকার হেলালুদ্দীন বলেন, ‘আমরা স্পটে যাওয়ার আগে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন তাকে (তুষ্টিকে) হাসপাতালে নিয়ে আসে। এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কিছুই বলতে পারছি না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘একটি ঘটনা শেষ হতে না হতেই আরও একটি ঘটনা ঘটে গেল। আমাদের জন্য অনেক বড় দুসংবাদ। আমরা তার মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা করছি।’