করোনার ভারতীয় ধরন নিয়ে যে উদ্বেগ সেটি ঠেকিয়ে রাখা গেল না। ভারত সীমান্তবর্তী বিভিন্ন জেলা, বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে তা। যাদের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে, তাদের বাড়ি সীমান্ত থেকে দূরে আর এদের কেউ সে দেশে যানওনি।
ভারত সীমান্ত বন্ধ এপ্রিলের ২৬ তারিখ থেকেই। এর পরও সে দেশ থেকে মানুষের আসা বন্ধ ছিল না। তবে বন্দরে নেয়া হয়েছে নানা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।
যারা এসেছেন, তাদের সীমান্তে করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ১৪ দিন সেখানেই থাকতে হয়েছে কোয়ারেন্টিনে। এই সময়ে যাদের মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়নি, তারা ফিরতে পেরেছেন বাড়িতে। আর যাদের করোনা শনাক্ত হয়েছে, তাদের চিকিৎসা নিতে হয়েছে হাসপাতালে।
ভারতের সঙ্গে স্থল বন্দর আছে এই জেলারও। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে এই সোনামসজিদ বন্দর নিয়ে ৬০ থেকে ৭০ জন এসেছেন । আর সীমান্তে কোয়ারেন্টিনে থেকেই তারা ফিরতে পেরেছেন বাড়িতে।
এরপরেও কেন, কীভাবে ভাইরাস ছড়াল-সেটির জবাব একটি হতে পারে, অবৈধপথে আসা-যাওয়া।
চোরাচালান, বিশেষ করে গরু আনতে এই জেলা থেকে প্রায়ই ভারতে গোপনে যাওয়ার প্রবণতা আছে। করোনাকালেও এটি বন্ধ নেই। আর যারা যাওয়া-আসা করেন, তাদের তো আর কোয়ারেন্টিন বা করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। তারা ভারত থেকে এসে অবাধে মিশছেন সাধারণের সঙ্গে।
এটি কেবল এই জেলার সমস্যা না, ভারত সীমান্তবর্তী প্রতিটি জনপদেই এই চিত্র।
স্থলবন্দর ছাড়াই অবাধ যাতায়াত
কুড়িগ্রামের শিমুলতলা এলাকায় ১০২১ সীমান্ত পিলারসংলগ্ন কোনো কাঁটাতার নেই। কলসের আকৃতি মতোই এখানে ভারত-বাংলাদেশ আলাদা হয়েছে। এখানকার প্রায় আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার এলাকা দিয়ে নানা সময়ই চলে যাতায়াত।
এই সীমান্তে ভারতের আসাম রাজ্যের ধুবড়ি জেলার গোপালগঞ্জ থানার ফাইসার কুটি গ্রাম এবং বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার কেদার ইউনিয়নের ছোট খামার গ্রাম।
ভারতের নাগরিকরা প্রায়ই বাংলাদেশে এসে হাটবাজার করে থাকেন। এই দুই গ্রামের মানুষেরা গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়ানোসহ বিভিন্ন কাজে প্রতিবেশীর মতোই চলাফেরা করে থাকেন।
কাঁটাতারহীন ভূরুঙ্গামারী উপজেলা পাথরডুবি ইউনিয়নের বাঁশজানি গ্রামেও একই অবস্থা। এখানে ভারত-বাংলাদেশের ঘর দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো কোন দেশের বাসিন্দার বসত।
বিএসএফ পাহারা আর সীমান্ত পিলার দিয়েই দুই দেশকে ভাগ করা হয়েছে। এই এলাকায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার দিনহাটা থানার দীঘলটারী গ্রাম।
এই সীমান্তে এমন চিত্র দেখা যায়, যেখানে দুটি পুকুরের মাঝের পার দিয়ে দেশ ভাগ হয়ে গেছে। বিজিবি-বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবাধে চলাফেরা করেন দুই দেশের নাগরিকরা।
জেলার ৯টি উপজেলার মধ্যে সাতটি উপজেলার সঙ্গে ভারতের তিনটি রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে ২৭৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৩২ কিলোমিটার সীমান্তে নেই কাঁটাতার। এ ছাড়া নদীপথ রয়েছে ৩১৬ কিলোমিটার।
এর মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম রাজ্যের সীমানায় কুড়িগ্রাম-২২ বিজিবির অধীনে ১৯৮ কিলোমিটার সীমান্ত।
জামালপুর-৩৫ বিজিবির আওতায় সীমানা প্রায় সাড়ে ৪৬ কিলোমিটার কাঁটাতার। আর ওপারে ভারতের আসাম ও মেঘালয় রাজ্য।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমানায় লালমনিরহাট-১৫ বিজিবির অধীনে ৩৬ কিলোমিটার সীমান্ত। এসব সীমন্তের বেশ কিছু পয়েন্ট দিয়ে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গরু, মাদকসহ চোরাচালান এবং অবৈধভাবে অনুপ্রবেশেরও ঘটনা ঘটছে।
কাঁটাতারবেষ্টিত ভারতের অভ্যন্তরে বাসিন্দাদের কৃষিকাজের জন্য বিএসএফ গেট খুলে দেয়ায় নো-ম্যানস ল্যান্ডে এসে চাষাবাদ করছেন সেখানকার কৃষকেরা। প্রায় সময় দুই রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তারা মেলামেশাও করে থাকেন।
করোনা দুর্যোগের মধ্যে সীমান্ত এলাকায় বেড়াতে এসে কাঁটাতার ঘেঁষে সেলফি তুলতে দেখা যাচ্ছে।
ছোট খামার গ্রামের বাসিন্দা শমসের আলী বলেন, ‘এখানে কোনো কাঁটাতার নাই। আমরা দুই রাষ্ট্রের মানুষ হলেও প্রতিবেশীর মতোই বসবাস।’
একই এলাকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘শুধুমাত্র পিলার দিয়েই ভারত-বাংলাদেশ বোঝানো হয়েছে। গরু-ছাগলকে ঘাস খাওয়াতে গেলে মাঝেমধ্যে তাদের গ্রামে যান বাংলাদেশিরা। তারাও আসেন বাজারহাট করতে।’
‘ভারতে যেভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে তাতে আমরা চিন্তিত। কখন যে কীভাবে এখানে ভাইরাস আসে বলা মুশকিল’-বলেন তিনি।
বাঁশজানি গ্রামের বাসিন্দা মো. শামীম বলেন, ‘এই গ্রামে ঘরবাড়ি দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটা ভারত-বাংলাদেশ। পুকুরের পাড় দিয়েও দুই দেশকে ভাগ করা হয়েছে।’
আজগর আলী বলেন, ‘যেখানে কাঁটাতার দিয়েই গরু, মাদক পাচার হয়, সেখানে কাঁটাতার না থাকলে কী হয় সবাই বুঝতে পারে।
‘বিএসএফ কাঁটাতারের গেট খুলে দিলে ওখানকার কৃষক এসে আবাদ করেন। মাঝেমধ্যে গরু-ছাগল আসলে তারা অনায়াসে এসে নিয়ে যান। যাদের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে তারা প্রায় সময় বেড়াতে আসেন।’
কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন হাবিবুর রহমান বলেন, সীমান্তবর্তী এবং বৃহৎ নদ-নদীময় জেলা হওয়ায় এখানে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
কুড়িগ্রাম-২২ ব্যাটালিয়ন (বিজিবি)-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জামাল হোসেন বলেন, ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কিংবা করোনার প্রভাব বিস্তারসহ চোরাচালান এবং অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে বিজিবি।