‘আমার মায়ের ভালোবাসা আর গাছের ভালোবাসার মধ্যে কোনো তফাত দেখতে পাই না। মা আমাকে যেভাবে কাছে ডাকে, গাছপালাও আমাকে সেভাবেই কাছে ডাকে।’
কথাগুলো বলছিলেন মাহমুদুল ইসলাম মামুন। রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষে চাকরির পেছনে না ছুটে স্বপ্ন ফেরি করছেন তিনি। বিলি করেন গাছ ও বই। নিজ গ্রামসহ আশপাশের ১০ গ্রামে নিজ উদ্যোগে হাজারের বেশি গাছ লাগিয়েছেন এ যুবক।
গাছ বিতরণের কারণ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গাছের জীবন আর আমার জীবন একটাই জীবন। শুধু পরিবেশ দিবসেই গাছের খবর নয়, আমার কাছে প্রতি ঘণ্টা, প্রতিদিন, প্রতি বছরের পুরো সময়েই পরিবেশ দিবস।’
শুরুর গল্প
২০১৩ সালের কথা। তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে বাংলায় স্নাতকে পড়তেন মাহমুদুল। সে সময় বাড়ি থেকে বাবা-মায়ের পাঠানো টাকা থেকে কিছু জমিয়ে রাখতেন তিনি। প্রতিবার ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার সময় রংপুর থেকে নানান জাতের ফলদ আর বনজ গাছের চারা নিয়ে যেতেন; রোপণ করতেন বাড়ির আশপাশে।
এভাবে চলতে চলতে একটা সময় পুরো গ্রামকে নিয়ে ভাবতে থাকেন মাহমুদুল। নিজের টাকা দিয়ে কেনা গাছের চারা বিতরণ শুরু করেন স্থানীয়দের মধ্যে। সঙ্গী সাইকেলটি নিয়ে প্রতিবেশীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গাছের চারা বিতরণ শুরু করেন।
গাছের প্রতি ভালোবাসা
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার আজিজনগর গ্রামে মাহমুদুলদের বাড়িটি বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে। বাবা আজহারুল ইসলাম চিনিকলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। মা মাহমুদা বেগম গৃহিণী। দুই ভাইয়ের মধ্যে মাহমুদুল ছোট।
প্রকৃতি আর পরিবেশকে সবুজ রাখতেই মাহমুদুল গাছ উপহার দেন সবাইকে।
তার বাড়ির ভেতরে অনেক ফলদ আর বনজ গাছপালা। ছায়া-নিবিড় এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা তরুণ মাহমুদুলের স্বপ্ন জাগে প্রকৃতি আর পরিবেশকে সবুজ রাখার পাশাপাশি আলোর প্রদীপ ছড়ানোর।
এমন স্বপ্ন নিয়েই নিজের টাকায় গাছের চারা বিতরণ করছেন ছয় বছর ধরে। এ ছাড়া পাড়ায়-মহল্লায় শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষকে জড়ো করে বসাচ্ছেন সাহত্যি পাঠের আড্ডা; উপহার দিচ্ছেন বই।
‘সন্ধ্যা রাতে পাঠশালা’
গাছ বিতরণের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ‘সন্ধ্যা রাতে পাঠশালা’। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার পাশাপাশি সবুজ প্রকৃতি গড়ার পদ্ধতিও শেখানো হয় তার এই পাঠশালায়। বর্তমানে তার এই পাঠশালায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭০ জন।
সাহিত্যপাঠের চর্চা বাড়াতে শিশু, কিশোর ও তরুণদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বই দিয়ে আসেন মাহমুদুল। আবার সপ্তাহ ঘুরলে সেই বই বদলে আরেকটি দিয়ে আসেন।
নিজেও লিখেছেন উপন্যাস। ২০১৪ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশ হয় তার ‘লাল ফিতায় অমিয়’ নামে একটি উপন্যাস।
টাকার উৎস
নিজের টাকায় গাছের চারা বিতরণ করা তরুণ মাহমুদুল টাকা কোথায় পান, এমন প্রশ্ন তোলেন অনেকেই।
এ ব্যাপারে মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এসব কাজে সবচেয়ে অনুপ্রেরণা জোগান আমার মা। বাবাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। বাবা-মায়ের আর্থিক সহযোগিতায় নিজেই একটি হাঁস-মুরগির ছোট খামার গড়ে তুলেছি। ডিম ও মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে গাছের চারা ও বই কেনা হয়।
‘এ ছাড়া বাবার একটা ছোট চা বাগান আছে। সেটাও দেখাশোনা করি। বাবা-মায়ের কাজে সাহায্য করে প্রতিদিন বই আর গাছের চারা চটের ব্যাগে ভরে সাইকেলে নিয়ে দূরে কোনো একটি গ্রামে গরিব শিশু-কিশোরদের উপহার দিই।’
এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের র্কমর্কতাদের হাতেও ফুল, ফলদ ও বনজ গাছের চারা উপহার দিয়েছেন মাহমুদুল।তার এ কাজ সম্পর্কে মা মাহমুদা বেগম বলনে, ‘বাড়িতে নিজের কাজের পাশাপাশি মানুষরে উপকার করে। প্রতিদিন সন্ধ্যা হলেই ৩০ জন বাচ্চা ওর কাছে পড়তে আসে। গাছ আর বই নিয়ে মানুষকে দেয়।
‘এসব দেখে মা হিসেবে ভালোই লাগে আমার। আমি চাই আমার ছেলে দেশ আর দেশের কল্যাণে কাজ করুক; এগিয়ে যাক।’
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মাহমুদুল আমাদের সমাজের অনন্য দৃষ্টান্ত। বর্তমান সমাজে কয়জন আছেন এভাবে প্রকৃতি, পরিবেশ আর সাহিত্য নিয়ে ভাবার। ওর কাজ আমাদের মুগ্ধ করে।’
নিজের বাড়িতে ডালিমগাছ দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘ওই দেখেন প্রায় দুই বছর আগে মাহমুদুলের দেয়া ডালিমগাছে এবার প্রচুর ফল এসেছে। আমি তার এ ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই।’