নারায়ণগঞ্জে করোনার কারণে বিপাকে পড়া ব্যবসায়ী সহায়তা চাওয়ার পর ত্রাণ বিতরণে বাধ্য করার ঘটনা নিয়ে ১০ দিন পর প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি। এতে ওই ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফা জহুরকে দোষী না করে সতর্ক করা হয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় মেম্বারের ভুল তথ্যে এ ঘটনা ঘটেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।
শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোস্তাইন বিল্লাহ ।
ডিসি বলেন, ‘স্থানীয় মেম্বার ভুল তথ্য দিয়েছেন। তিনি ফরিদ আহমেদের সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে তার আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন ছিল। স্থানীয় মেম্বারের ভুল তথ্যে এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।’
পাঁচ পৃষ্ঠার ওই তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, ইউএনওকে ভবিষ্যতে ‘৩৩৩’ ফোনের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুধু স্থানীয় জনপ্রতিনিধির ওপর নির্ভর না করে এলাকার মুক্তিযোদ্ধা, মসজিদের ইমাম এবং প্রয়োজনে গণমাধ্যমকর্মীদের সহায়তা নিতে বলা হয়েছে।
মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘ইউএনওকে দোষী নয়, সতর্ক করা হয়েছে। কারণ, ঘটনার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির যথাযথভাবে তথ্য দিতে না পারাকেই দায়ী করা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সেবাগ্রহীতার আর্থিক সংগতির বিষয়ে যথাযথ তথ্য দিতে পারেননি। তাই ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাকে আরও সতর্ক হওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।’
ডিসি বলেন, ‘রোববার প্রতিবেদনটি জমা দেয়ার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার রাতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম ব্যাপারী আমার বাসায় সরকারি ডাকবাংলোয় এসে প্রতিবেদন জমা দিয়ে গেছেন।’
ডিসি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদনটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। যেহেতু প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয়ের অধীন কাশীপুর ইউনিয়নের ওয়ার্ড মেম্বারকে ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে। সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে, পরবর্তী সময়ে সেভাবেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
গত ২০ মে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য চাওয়ার দুই দিন পর নিজেই ত্রাণ বিতরণে বাধ্য হন বিপাকে পড়া ব্যবসায়ী ফরিদ আহমেদ
তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার আইয়ুব আলীর মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তিনি এখনও ফোন বন্ধ করে রেখেছেন।
এর আগে কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। সেটি দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর তারা আরও সাত দিন সময় চেয়ে নেন।
যা ঘটেছিল
নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের দেওভোগ নাগবাড়ি এলাকার ফরিদ আহমেদ গত ২০ মে খাদ্যসহায়তা চেয়ে ৩৩৩ নম্বরে কল দেন।
খাবার নিয়ে আসেন উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, অফিস সহকারী কামরুল ইসলাম। পরে তারা ভবন দেখে ফোন দিলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা আসেন ঘটনাস্থলে। দেন শাস্তির ঘোষণা।
জানান, সরকার প্রতি প্যাকেটে যে পরিমাণ খাবার দেয় দুস্থদের, সেই পরিমাণ খাবারসহ ১০০ প্যাকেট করে বিতরণ করতে হবে।
নির্দেশমতো ২২ মে বিকেলে ফরিদ আহমেদ সেই খাবার বিতরণও করেন। আর সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউএনও স্বয়ং।
ঘটনাস্থলে গিয়ে ফরিদের জীবনের কাহিনি জেনেছে নিউজবাংলা। কিন্তু জানেননি ইউএনও।
ফরিদের কাহিনি প্রকাশ হলে পরদিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা তার বাসায় গিয়ে সব জেনে আসেন। বিকেলেই তাকে টাকা ফিরিয়ে দেয়া হয়
ফরিদ থাকেন চারতলা বাড়িতে, গেঞ্জির কারখানাও আছে। এটুকু সত্য। কিন্তু এর পেছনে আরও অনেক কাহিনি আছে।
সেই কারখানা বন্ধ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। পরে সংসার চালাতে সেই ব্যক্তি কাজ নিয়েছেন আরেক কারখানায়, কিন্তু চোখের সমস্যায় সেই কাজও করতে পারেন না। সংসারের আয় নেই। আর তিনি যে বাসায় থাকেন, সেটি তাদের ছয় ভাই-বোনের। নিজের অংশ কমই।
এসব কথা না জেনেই ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য চাওয়ায় কেবল বাড়ি দেখে আর কারখানা থাকার খবর শুনে তাকে ১০০ জনকে খাবার বিতরণে বাধ্য করেন ইউএনও আরিফা জহুরা।
সেদিন নিউজবাংলা প্রকাশ করে ‘ত্রাণ সত্যিই দরকার ছিল ফরিদের, ভুল ইউএনওর’ শিরোনামে সংবাদ।
তোলপাড় হলে পরদিন ফরিদ আহমেদের বাড়িতে একে একে বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গিয়ে তার জীবনের কাহিনি শুনে আসেন। সেদিন বিকেলের দিকে চুপি চুপি ফরিদকে টাকা ফেরত দেয়া হয়।
ফরিদ আহমেদকে টাকা তুলে দেয়ার ঘটনাতেও লুকোচুরি করেছে প্রশাসন। নিজেরা না গিয়ে টাকা দেয়া হয় স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটির এই নেতাকে দিয়ে
এই টাকা ফরিদের হাতে তুলে দিয়েছেন দেওভোগ নাগবাড়ি পঞ্চায়েত কমিটির উপদেষ্টা সাহিনুর আলম।
গণমাধ্যমের কাছে তিনি দাবি করেছেন, এই টাকা তিনি নিজে দিয়েছেন। তবে ডিসি মোস্তাইন বিল্লাহ নিশ্চিত করেছেন, টাকা দেয়া হয়েছে প্রশাসনের তহবিল থেকে।
তদন্ত কমিটি গঠন
গত ২২ মে ফরিদ আহমেদ ত্রাণ বিতরণে বাধ্য হওয়ার পর সেই রাতেই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়।
পরদিন সকালেই ঘটনাটি তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠনের কথা জানান ডিসি মোস্তাইন বিল্লাহ।
কমিটির প্রধান করা হয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম বেপারীকে। অন্য দুই সদস্য হলেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রেজাউল করিম ও সহকারী কমিশনার কামরুল হাসান মারুফ।
কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু তারা তা না দিয়ে ২৬ মে আরও সাত দিন সময় চেয়ে আবেদন করেন। ২৭ মে সে আবেদন গ্রহণ করেন ডিসি।
তবে সময় বাড়ানোর পর ওই ঘটনাটির তদন্ত কেন তিন দিনে শেষ করা যায়নি, সেই প্রশ্নের জবাব দেয়নি প্রশাসন।