দেড় বছর বয়সে ধান ভানার চুলার আগুনে দুই হাত ও মুখের কিছু অংশ পুড়ে যায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম মারুফের। এরপর থেকে দুই হাত অকেজো হয়ে পড়ে তার।
মারুফের বয়স এখন ৩০ বছর। হাতের আঙুলের ছাপ ও আইরিস স্ক্যান জটিলতায় জন্মনিবন্ধন ও জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাচ্ছেন না তিনি। সরকারি ভাতা না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে নেমেছেন ভিক্ষায়।
মারুফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আজও আমি বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারিনি। কোনো সরকারি ভাতাও পাই না। এনআইডি এবং জন্মনিবন্ধন সনদও মেলেনি।’
তিনি জানান, পুড়ে যাওয়া দুই হাতের ফিঙ্গার প্রিন্ট এবং মুখের অনেকাংশ পুড়ে যাওয়ায় চোখের আইরিস স্ক্যান জটিলতায় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি। এসব কারণে কাগজে-কলমে আজও মেলেনি তার নাগরিকত্ব।
ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন মারুফ। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মারুফ সবার ছোট। বাবা আসাদ আলী মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। বৃদ্ধা মা সুফিয়া বেগমও ব্রেন স্ট্রোকে দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী।
ছোটবেলা থেকে মারুফের ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে খেলোয়াড় হবেন। পঙ্গুত্ব নিয়েই ক্রীড়াচর্চায় তার আগ্রহ ছিল। ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি আঞ্চলিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে ফুটবল খেলতেন। এলাকায় ফুটবলে সুনামও কুড়িয়েছিলেন মারুফ। তবে শারীরিক সীমাবদ্ধতায় বেশি দূর এগোতে পারেননি।
পরে দীর্ঘদিন নাইট গার্ডের কাজ করেছেন হাটবাজারে। বর্তমানে এলাকায় ভিক্ষা করছেন। মারুফ বলেন, ‘জন্মনিবন্ধনের জন্য পৌরসভায় গেলে টিকার কার্ড এবং বাড়ির ট্যাক্সের কাগজ নিয়ে আসতে বলে। টিকার কার্ড নাই। বাবা-মা আমাকে টিকা দিয়েছে কিনা তাও জানি না। আর ট্যাক্সের কাগজ? মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই।
‘ভাঙা কুঠরি ঘরে থাকি। খেয়ে না খেয়ে দিন চলে। ট্যাক্স দিব কোথায় থেকে আর ট্যাক্সের কাগজ পাব কোথায়? ভোটার আইডি কার্ড করতে গিয়েও একই সমস্যা।’
ঘোড়াঘাট পৌরসভার মেয়র আব্দুস সাত্তার মিলন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি একাধিকবার তাকে জন্মনিবন্ধন করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আসতে বলেছিলাম। জন্মনিবন্ধন করতে বেশ কয়েকটি ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়। কিন্তু সে কোনো কাগজপত্র জমা দিতে পারেনি। জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম এখন সরাসরি অনলাইন প্রক্রিয়াতে চলে গিয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনলাইনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সাবমিট করতে না পারলে জন্মনিবন্ধন করা সম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়াতে আমাদের কোনো হাত নেই। আবার জন্মনিবন্ধন বা এনআইডি কার্ড না থাকায় প্রতিবন্ধী হওয়ার পরেও আমরা তাকে কোনো সরকারি সহায়তা দিতে পারিনি।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শাহজাহান মানিক বলেন, ‘মারুফসহ আরও দুই প্রতিবন্ধীকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আমরা ২৪ মে দ্বিতীয় দফায় কমিশনে চিঠি পাঠিয়েছি। এর আগে তারা কেন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারেনি, তা আমার জানা নেই।
‘গত মার্চে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ আমাকে জানায়, মারুফ নামে এক প্রতিবন্ধী ভোটার তালিকায় যুক্ত হতে পারেনি। ফলে সে সরকারি বিভিন্ন সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পরে মারুফকে অফিসে ডেকে নিয়ে তার ছবি নিয়েছি।’
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শাহজাহান বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অনুমোদন পেলেই আমরা তাদেরকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারব। ভোটার আইডি কার্ড তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে। আশা করছি আগামী এক মাসের মধ্যেই তারা ভোটার তালিকায় যুক্ত হতে পারবে।’