রাত সাড়ে ৮টা। রাজশাহী নগরীর উপশহর এলাকায় একদল মানুষের জটলা।
জটলা ঠেলে একটু এগোতেই চোখে পড়ল একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। সেটি দেখতেই এই ভিড়।
অটোরিকশা দেখার পর এত মানুষের কৌতূহলের কারণ বোঝা যায়। এর সামনের অংশে আছে একটি টিভি মনিটর। যাত্রীরা রিকশায় চড়ে বসলেই উপভোগ করতে পারেন সিনেমা কিংবা নাটক। গন্তব্যে পৌঁছানোর পুরো সময় বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে এখানে।
অটোরিকশার সিটগুলো বিলাসবহুল কোচের আদলে বানানো। পেছনের দিকের রাস্তা ও যানবাহনের দিকে নজর রাখতে বসানো হয়েছে ক্যামেরা। পুরো অটোরিকশায় লাগানো বিভিন্ন রঙের বাতি। আছে পানি খাওয়ার ব্যবস্থাও।
এসব বৈশিষ্ট্য এই অটোরিকশাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী রূপ। তাই যানজটে বা সড়কের পাশে কোথাও এটি থামলে চারপাশে উৎসুক লোকজন জড়ো হয়ে যান। কেউ সেলফি তোলেন, কেউ করেন ভিডিও। সেই সঙ্গে অটোচালককে করা হয় কৌতূহলী নানা প্রশ্ন।
অটোরিকশাটি চালান শাহিন আলম। তিনিই এটির মালিক। দর্শনার্থীদের সব প্রশ্নের উত্তর তিনি খুশি হয়েই দেন। মাঝে মাঝে প্রশ্নের ফাঁকে অনেকেই শখ করে অটোর আরামদায়ক আসনে গা এলিয়ে দেন।
এমন একটি অটোরিকশা তৈরির পেছনের গল্প জানতে কথা হয় শাহিন আলমের সঙ্গে। নিউজবাংলাকে তিনি জানালেন, প্রায় ৪ মাস আগে এটি তৈরির কথা মাথায় আসে।
শাহিন বলেন, ‘শহরের আধুনিকায়ন আর সৌন্দর্য দেখতে অনেকেই আসেন। তাহলে ভিন্ন আদলে একটি অটোরিকশা বানালে নিশ্চয়ই মানুষের সাড়া পাওয়া যাবে। এমন ভাবনা থেকেই আধুনিক এই অটোরিকশা বানানোর সিদ্ধান্ত নিই। সেটি বাস্তবায়নে লেগে যায় এক মাস।’
তিনি জানান, মনের মতো করে একটি বাহন তৈরি করার জন্য তিনি মিস্ত্রির কাছে যান। কিন্তু মিস্ত্রিরা বলেন, এটা সম্ভব না। অনেকে বলেন, সম্ভব হলেও এতে অনেক খরচ হবে। তাই সবাই তাকে নিরুৎসাহিত করেন। তবে তাতে দমে না গিয়ে কাটাখালি, ভদ্রা ও আমচত্বর এলাকার তিনজন মিস্ত্রির সাহায্য নিয়ে এই অটোরিকশাটি তৈরি করেন তিনি।
শাহিন বলেন, ‘আমার এই গাড়িতে টিস্যু, ফিল্টার পানি, পানি খাওয়ার জন্য ওয়ানটাইম গ্লাস রাখা হয়েছে। গরমে যাতে যাত্রীরা কষ্ট না পান, সে জন্য দুটি ফ্যানও আছে। অটোরিকশার ভেতর বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে আমার মোবাইল ফোনের নম্বর। রিজার্ভ নেয়ার জন্য লোকজন এই নম্বরে ফোন দেন।’
এই অটোরিকশা বানাতে মোট ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ পড়েছে বলে জানান শাহিন। ঋণ নিয়ে তিনি এটি বানিয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে এর জন্য কিস্তি দিতে হয় দেড় হাজার টাকা।
শাহিন বলেন, ‘আগে প্রতিদিন সাত থেকে আট শ টাকা আয় হতো। এখন এক হাজার, বারো শ টাকা আয় হয়। রিজার্ভ ভাড়াই বেশি। অনেকেই কল দিচ্ছেন। রিজার্ভ ভাড়া নিয়ে ঘুরছেন। ঘণ্টায় দুই শ টাকা ভাড়ায় যাত্রী নিই। যখন রিজার্ভ থাকে না, তখন অন্য সব অটোর মতোই ভাড়া নিই।’
শাহিন আলমের বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার মাইপাড়া বাজারে। আগে তিনি ভাড়ায় মাইক্রোবাস চালাতেন। সেই কাজ ছাড়েন ২০১১ সালে।
এরপর পাঁচ বছর পিকআপ চালিয়ে ২০১৭ সালে অটোরিকশাচালকের পেশা বেছে নেন শাহিন।
তিনি বলেন, ‘আধুনিক মানের এই বাহন বানানোর সময় অনেকেই অনেক কথা বলেছিলেন, নিরুৎসাহিত করেছেন। অনেকেই বলেছিলেন পাঁচ টাকার ভাড়ায় এভাবে গাড়ি চালিয়ে টাকা উঠবে না। যখন বানানো হয়ে গেল, তখন প্রশংসা করছেন অনেকেই। যাত্রীরা সিটগুলো দেখে খুব প্রশংসা করেন।
‘আমি অনেক জেদ করেই এটি করেছি। ক্ষতি হবে আমার হবে, এমনও বলেছি। ভবিষ্যতে এটি আরও উন্নত করব।’
শাহিন জানান, তিনি আরও একটি অটোরিকশা বানাবেন, যেটি হবে এর চেয়েও আধুনিক।
যাত্রীদের এত সুবিধা দিয়ে আপনার লাভ কী?
শাহিন উত্তরে বলেন, ‘লাভ-লসের কথা চিন্তা করে করি নাই। সবাই সুন্দর বলে, তাতেই আমি খুশি। অনেকেই এটিকে দেখে ভালো লেগেছে বলে যখন মন্তব্য করে, তখনই আমার ভালো লাগে।’
যাত্রীরা এমন অটোরিকশা শহরে আরও চান
রাজশাহীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আসরাফুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এখানে কত অটো আছে। তবে সবার কন্ডিশন ভালো না। তাই এটি দেখে আমাদের সুযোগ-সুবিধার কথা মনে পড়ছে। এটি দেখে নিশ্চয়ই আরও অনেকেই করবে।’
অটোরিকশা নিয়ে আলাপের ফাঁকে রাত সাড়ে ৯টার দিকে শাহিনের মোবাইল ফোনে কল আসে এক যাত্রীর। দরদাম মিটে গেল। শাহিন ছুটলেন যাত্রীকে তুলতে।