নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে সেই আগুন তৎক্ষণাৎ নিভিয়ে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনার পরিকল্পনা করেছিলেন রিতা বেগম। তার পরিকল্পনার সঙ্গে স্বামী ও সন্তানও জড়িত ছিলেন। কিন্তু নিজের শরীরে লাগানো আগুন নেভাতে ব্যর্থ হন তিনি। ফলে আগুনে পুড়ে মারা যান রিতা বেগম।
গৃহবধূর গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে হত্যা মামলার ঘটনার তদন্তে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে নওগাঁর পুলিশ সুপার আবদুল মান্নান মিয়া তার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে আবদুল মান্নান মিয়া বলেন, গত ৩০ এপ্রিল রাতে নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়নের চকচাপাই গ্রামের মোসলেম প্রামাণিকের স্ত্রী রিতা বেগম গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হন। পরদিন বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান।
এ ঘটনায় রিতা বেগমের মা রোকেয়া বেওয়া জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে রিতা বেগমকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগে প্রতিপক্ষ আলামিন প্রামাণিক, সানোয়ার প্রামাণিক ও জলিল প্রামাণিকের বিরুদ্ধে নওগাঁ সদর থানায় মামলা করেন।
অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নেমে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই উজ্জ্বল হোসেন জানতে পারেন, গত ২৪ এপ্রিল অজ্ঞাত একটি নম্বর থেকে রিতা বেগমের প্রতিবেশী ময়েন উদ্দিনের মোবাইল ফোনে একটি খুদে বার্তা (এসএমএস) আসে। ওই খুদে বার্তায় রিতা বেগম ও তার পরিবারকে পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয়া হয়। সেই খুদে বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে রিতা বেগম ২৯ এপ্রিল জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষ আলামিন প্রামাণিক, সানোয়ার প্রামাণিক ও জলিল প্রামাণিকের বিরুদ্ধে নওগাঁ সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এ ঘটনার পরদিন ৩০ এপ্রিল রাতে রিতা বেগম গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হন এবং ১ মে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
অজ্ঞাতনামা মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ মোবাইল নম্বরটির মালিক সাইফুল ইসলামকে শনাক্ত করেন। পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদে সাইফুল ইসলাম দাবি করেন, গত ২৪ এপ্রিল তার মোবাইল ফোনটি রানীনগর উপজেলার ত্রিমোহনী বাজার থেকে হারিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে পুলিশ তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় মোবাইল ফোনটি রিতা বেগমের বাসা থেকে উদ্ধার করে। হারিয়ে যাওয়া মোবাইল ফোন ও সিমটি উদ্ধারের পর জিজ্ঞাসাবাদে রিতা বেগমের ১৫ বছর বয়সী মেয়ে আরিফা খাতুন রিতা বেগমের মৃত্যুর ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেয়। বুধবার বিকেলে আরিফা স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।
১৬৪ ধারায় আরিফার দেয়া জবানবন্দির বিষয়টি উল্লেখ করে পুলিশ সুপার বলেন, নওগাঁর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের কাছে আরিফা বলে, তার বাবা মোসলেম প্রামাণিক গত ২৪ এপ্রিল রানীনগর উপজেলার ত্রিমোহনী বাজারে একটি ফোন কুড়িয়ে পান। ওই মোবাইল ফোনে থাকা সিম ব্যবহার করে তার মা রিতা বেগম ওই দিন রাত সাড়ে ৩টার দিকে নিজেই প্রতিবেশী ময়েনের কাছে এসএমএসটি পাঠান যে, রিতা বেগমকে মেরে ফেলা হবে এবং পরবর্তী সময়ে থানায় জিডি করেন।
কুড়িয়ে পাওয়া ফোন ও সিমটি রানীনগর উপজেলার নয়া হরিশপুর গ্রামের সাইফুল হোসেন নামের এক ব্যক্তির। তিনি ত্রিমোহনী বাজারে ধান বিক্রি করতে এসে ফোনটি হারিয়ে ফেলেন। এরপর গত ৩০ এপ্রিল রিতা বেগম পরিকল্পনা করেন, তিনি নিজেই নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবেন। সেই সময় তার স্বামী মোসলেম ও মেয়ে আরিফা চিৎকার করে মানুষ ডাকবেন এবং তৎক্ষণাৎ পানি ঢেলে আগুন নিভিয়ে ফেলবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০ এপ্রিল রাতে রিতা বেগম পরনের ম্যাক্সিতে আগুন ধরিয়ে দেন। কিন্তু আগুন ধরিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং নেভাতে ব্যর্থ হন। আগুন নেভাতে না পেরে রিতা বেগম আত্মরক্ষার্থে বাড়ির পাশে পুকুরে ঝাঁপ দেন। ওই রাতেই তাকে উদ্ধার করে প্রথমে নওগাঁ সদর হাসপাতালে এবং পরে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ সুপার আব্দুল মান্নান মিয়া বলেন, হত্যা মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে রিতা বেগমের স্বামী ও সন্তানের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে কি না, সে বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও আইনি বিষয়টি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ কে এম মামুন খান চিশতী, আবু সাঈদ ও সুরাইয়া খাতুন, নওগাঁ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।