ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে অস্বাভাবিক জোয়ারে সাতক্ষীরার ছয় উপজেলায় ১২০ কিলোমিটার বাঁধ তছনছ হয়ে গেছে। অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে মাছের সাড়ে ৭ হাজার ঘের। বিস্তীর্ণ এলাকায় দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। ভেঙে পড়েছে বিদ্যুৎ ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। উপকূলে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর নিয়ে বিপাকে পড়েছে হাজারো মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী সাতক্ষীরাসহ খুলনা অঞ্চলে ১২০ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। জোয়ারের তীব্রতা কমে গেলেও কয়েকটি এলাকায় নতুন করে ভাঙন দেখা দিয়েছে।
জেলা মৎস্য বিভাগ জানায়, সাতক্ষীরার ছয় উপজেলার ২৯ ইউনিয়নে মাছের ৭ হাজার ৫৬০টি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট ৬ হাজার ৭৩৮ হেক্টর আয়তনের এসব ঘের ভেসে মাছ ও অবকাঠামোগত ৫৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে বিস্তীর্ণ এলাকার চিংড়িঘের এখন পানির নিচে।
জেলা প্রশাসন জানায়, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসকবলিত শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের ঝাপা গ্রামে বেড়িবাঁধের চারটি পয়েন্ট, পাতাখালিতে দুই, রমজাননগরে দুই, গাবুরায় তিন, কৈখালির দুই, ভেটখালিতে এক, বুড়িগোয়ালিনীতে তিনটি ও নূরনগর ইউনিয়নে একটি পয়েন্টসহ ১৭ স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে জোয়ারের পানি গ্রামে ঢুকে পড়েছে।
কালীগঞ্জের পূর্ব নারায়ণপুর গ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলা হাসপাতাল, বাস টার্মিনালসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।
কালীগঞ্জে সোহরাওয়ার্দী পার্কের পাশে কাঁকশিয়ালী নদীর পানি উপচে উপজেলা সদরের বেশ কিছু এলাকা তলিয়ে গেছে। উপজেলা পরিষদের কাছে যমুনা নদীর পানি উপচে নাজিমগঞ্জ বাজার ও উপজেলা পরিষদ চত্বরসহ বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ভেসে গেছে।
উপজেলার ঘোজাডাঙ্গা এলাকায় কাঁকশিয়ালীর বাঁধ উপচে উত্তর ও দক্ষিণ শ্রীপুরসহ তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। কপোতাক্ষের পানিতে আশাশুনি উপজেলার কুড়িকাহনিয়া লঞ্চঘাট, হরিশখালি, রুইয়ার বিল, সুভদ্রকাটিসহ কয়েকটি গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে।
আশাশুনি সদরের দয়ারঘাট ও বলাবাড়িয়ায় বেড়িবাঁধ উপচে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার খাজরা ইউনিয়নের পিরোজপুরের রাজবংশীপাড়ায় কপোতাক্ষের বাঁধ উপচে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে পানি। আশাশুনির বামনডাঙ্গা গ্রামে খোলপেটুয়া নদীর বাঁধ উপচে কয়েক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
গাবুরার জেলেখালি, নেবুবুনিয়া, চাঁদনীমুখা, গাগড়ামারি, পদ্মপুকুরের উত্তর ও দক্ষিণ পাতাখালি, কামালকাটি, ঝাঁপা, সোনাখালিসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম নদীতে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে ভাসছে। গ্রামবাসী ও জনপ্রতিনিধিরা বালুর বস্তা ফেলে বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।দেবহাটা উপজেলার কোমরপুরে ইছামতী নদীর বেড়িবাঁধ উপচে বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সদর উপজেলার হাড়দ্দহ মসজিদের পাশে ও তালা উপজেলার পাখিমারা বিলে টিআরএম-এর বাঁধ ভেঙে ভেসে গেছে কয়েকটি গ্রাম।
মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সেতু উপচে চুনা নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে এলাকা। গ্রামবাসী গবাদিপশুসহ সহায়-সম্পদ নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবারও সাতক্ষীরায় দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টির সঙ্গে বইছে ঝোড়ো হাওয়া। পূর্ণিমার ভরা কোটালে ও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে সাতক্ষীরায় জোয়ারের পানি তলিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন জনপদ ও অবকাঠামো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ও সড়ক ভেঙে নোনা পানি ঢুকে পড়েছে গ্রামে। পানির তোড়ে জেলার কয়েকটি স্লুইসগেট এখন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
দেবহাটার টাউনশ্রীপুরে ইছামতী নদীর কাছে এবং সুশীলগাঁতিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি স্লুইসগেটে ফাটল দেখা দিয়েছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, শ্যামনগর, আশাশুনি, কালীগঞ্জ, দেবহাটা, সাতক্ষীরা সদর ও তালা উপজেলার ২৯ ইউনিয়নে মাছের ৭ হাজার ৫৬০টি ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মোট ৬ হাজার ৭৩৮ হেক্টর আয়তনের এসব ঘের ভেসে মাছ ও অবকাঠামোগত ৫৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও দেবহাটা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকার চিংড়িঘের এখন পানির নিচে।
আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হোসেন খান জানান, এলাকায় ১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমির মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেবহাটা উপজেলায় ২০০টি ঘের পানিতে তলিয়ে আছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুজার গিফারী বলেন, ১ হাজার ৬০০ হেক্টরের ২ হাজার ৫০০ ঘেরের মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খন্দকার রবিউল ইসলাম জানান, তার এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের কাজ চলছে।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে মাছের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি এখনও পুরোপুরি নিরূপণ করা যায়নি।