দেশের উপকূলে আঘাত হানেনি ইয়াস। আছড়ে পড়েছে পাশের দেশের ওড়িশায়। তবে এই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সারা দেশে চার শিশুসহ সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জোয়ারে পানিতে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। ভেসে গেছে চিংড়ির ঘের। নষ্ট হয়েছে ফসলের জমি। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন প্রশাসনের লোকজন। বিভিন্ন স্থানে দেয়া হয়েছে সহায়তা। তবে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি।
কোন উপজেলায় কতজন পানিবন্দি
জোয়ারের পানিতে বাগেরহাটের চার উপজেলার প্রায় ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেসে গেছে ২ হাজার ৯১টি চিংড়ি ঘের। তলিয়ে গেছে কাঁচা-পাকা রাস্তা।
মোরেলগঞ্জ উপজেলার পৌর সদর, বারইখালী, খাউলিয়া, বহরবুনিয়া, পুটিখালী ও বলইবুনিয়া ইউনিয়নে পানিবন্দি প্রায় ১ হাজার পরিবার।
প্রায় ১১শ পরিবার পানিবন্দি শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা, সাউথখালি ও রায়েন্দা ইউনিয়নের বগি, চালতাখালী, আশারকোল, গাবতলা, কদমতলা ও খুড়িয়াখালী গ্রামে।
উপজেলার সাউথখালি ইউনিয়নের বগি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক আকন বলেন, ‘দুপুরের পর থেকে জোয়ারের পানি নামতে শুরু করেছে। পানি নামতে শুরু করলেও এখনও আমরা জলমগ্ন অবস্থায় আছি। বাড়ির আশপাশে ডোবা নালা ও খালে পানি আটকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।’
মোংলা উপজেলা চিলা, চাঁদপাই ও বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের প্রায় ৮শ পরিববার পানিবন্দি। শতাধিক পরিবার পানিবন্দি রামপাল উপজেলার হুকরা, বাঁসতলি ও পেড়িখালী ইউনিয়নের তালবুনিয়া, লাজনগর ও শ্রফলতলা গ্রামে।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী বিশ্বজিৎ বৈদ্য বলেন, জোয়ারের পানি নেমে যাচ্ছে। জেলার নিম্নাঞ্চলের কিছু গ্রামের মানুষ এখনও পানিবন্দি রয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নাঞ্চলগুলোর পানিও দ্রুত নেমে যাবে।
শরণখোলা উপজেলা চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত বলেন, ‘পানি নামতে শুরু করেছে। বলেশ্বর নদী তীরের এলাকাগুলোতে এখনও পানি রয়েছে। তবে সমস্যা হচ্ছে পানিতে ডোবা, নালা, খাল ও পুকুর পানি আটকে থেকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।’
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস. এম রাসেল বলেন, জোয়ারের পানির প্রভাবে জেলার দুই হাজার ৯১টি চিংড়ি ঘের ভেসে গেছে। এর মধ্যে রামপালে নয়শ ১৭টি, মোংলায় ছয়শ ৮৫টি, মোরেলগঞ্জে তিনশ ৪৫টি ও শরণখোলায় একশ ৪৪টি ঘের ভেসে গেছে।
জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে চিংড়ি ঘেরমোরেলগঞ্জর নিশারবাড়ীয়া গ্রামের চাষি রুবেল শরিফ বলেন, ‘মোর ছোট বড় মিল্লাহ ৬ বিঘার দুইডা ঘের আছে। ধার দেনা কইরা দুই লাখ টাহার মাছ ছারছালাম, সব ভাসাইয়া লইয়া গেছে। মোর এহন আর কিছু নাই।’
রামপালের হুকরা গ্রামের বাসিন্দা চাষি মনোরঞ্জর ঢালি বলেন, ‘সব মিলে আমার ১২ বিঘার তিনটি ঘের রয়েছে। যার মধ্যে দুটি পুরোপুরি ভেসে গেছে। তিন লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে আমার। আমার মতো গ্রামের অন্য চাষিদেরও একই অবস্থা। আমাদের পুরো উপজেলার মাছ চাষিদের সবাই কম বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।’
ভোলার উপকূলীয় এলাকার ৩০টি চর প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ। তলিয়ে গেছে কমপক্ষে ১০ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ও সবজি।
দিনভর মেঘনার পানি বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
প্রবল জোয়ারের চাপে জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৪০ মিটার অংশ ভেঙে গেছে। এ ছাড়া আরও ১৫টি পয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বুধবার দুপুরের পর মেঘনায় জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ জনপদ। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি ভেসে গেছে পুকুর ও মাছের ঘের। তলিয়ে গেছে কমপক্ষে ১০ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধান ও সবজি।
উপকূলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে সাইক্লোন সেন্টারে।
অতি জোয়ারে ঢালচর, কুকরি-মুকরি, চরপাতিলা, চরজ্ঞান, সোনার চর, কুলাগাজীর তালুক, চর যতিন, চর শাহজালাল ও কলাতলীর চরে ৩ থেকে ৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছে।
সাগর মোহনায় ডালচরের ইউনিয়নের মরজিনা বেগম বলেন, ‘আমাগো খোঁজখবর কেউ রাহেনা। গত তিনডা দিন ধইরা পানির লগে যুদ্ধ কইরা টিক্কা আছি। পানি উঠলে আমাগো দুরভোগের শেষ নাই। রান্না করতো পারি না, খাইতো পারি না। পোলাই ছাউন লইয়া অনেক কষ্টের মইদ্ধে আছি। ভানের পানিতো আমাগো ঘর পইরা গেছে।
‘এহন ঘর কেমনে ঠিক করমু পোলাইন ছাউন লইয়া কোন জায়গা থাকমু সেই চিন্তায় ও বাচি না। শুধু আমি না। আমাগো মতো অনেক মাইনষের ঘর দুয়ার পানিতে ভাসাইয়া লয়া গেছে মাথা গোছানের মতো জায়গা নায়। এহন সরকার যদি আমাগো দিকে চায় তাহইলে আমাগো কিছুডা রক্ষা হইব।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাবুল আক্তার জানান, বাঁধের বাইরে যেসব নিচু এলাকা রয়েছে, সবগুলো তলিয়ে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, জেলায় ৩২৫ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ৭৫ কিলোমিটার বাঁধ সিসি ও জিও ব্যাগে মোড়ানো থাকলেও ২৫০ কিলোমিটার বাঁধ মাটির তৈরি। যার মধ্যে প্রায় ২ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চরফ্যাশনে বাঁধের ৫টি পয়েন্ট, মনপুরায় ৩টি পয়েন্ট, বোরহানউদ্দিনে ২টি, লালমোহনে ২টি, তজুমদ্দিন, দৌলতখান ও সদরে ১টি করে পয়েন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ মেরামতের কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বাবুল আক্তার।
ইয়াসের প্রভাবে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কক্সবাজার জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে উপড়ে পড়েছে গাছপালা। বিধ্বস্ত হয়েছে পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি। জোয়ারের পানির তোড়ে ভেঙে গেছে সেন্টমার্টিনের প্রধান জেটিঘাট। টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে বেড়িবাঁধের ব্লকে ধস নেমেছে।
সদর, মহেশখালী, পেকুয়া, চকরিয়া ও টেকনাফের ১৬ ইউনিয়নে দুই হাজার ৯৬ টন লবণের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
শহরের সমিতিপাড়া, নুনিয়ারছড়া পানিরকুপপাড়া, গোদারপাড়াসহ অন্তত ৮টি এলাকায় ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়ে হাজারও মানুষ।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হাবিব খান বলেন, দ্বীপে অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে যে কোনো সময় সেন্টমার্টিন তলিয়ে যাবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
মাতারবাড়ির ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাস্টার মাহমদুল্লাহ্ জানিয়েছেন, জোয়ারের পানিতে মাতারবাড়ির ইউনিয়নের ৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে। এরইমধ্যে ৫০ থেকে ৮০টি ঘরবাড়ি ভেঙে গেছে। স্থানীয় প্রশাসনের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
কুতুবদিয়ার বাসিন্দা মো. সিকদার জানান, কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং, আলী আকবরডেইল ও কৈয়ারবিল ইউনিয়নে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ভেঙে ২০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এতে করে প্রায় শতাধিক ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ।
একইভাবে মহেশখালীর ধলঘাটাসহ বিভিন্ন এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে প্রায় অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সংবাদকর্মী রকিয়ত উল্লাহ।
চট্টগ্রামের চারটি উপজেলায় বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সজীব কুমার চক্রবর্তী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উপকূলীয় চার উপজেলায় জোয়ারের পানিতে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে বাঁশখালী উপজেলার গণ্ডামারা, ছনুয়া ও খানখানাবাদে বেড়িবাঁধ ভাঙনের মধ্যে পড়েছে।
‘সেখানে পানি বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। সন্দ্বীপ উপজেলার সারিকাইত ইউনিয়নে বেড়িবাঁধের একটি অংশে প্রায় পাঁচ মিটার ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, উপকূলীয় আনোয়ারা উপজেলায় সাঙ্গু নদীর তীরে রায়পুর ইউনিয়নে একটি বেড়িবাঁধ ভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। জোয়ারের পানি নদী তীরের কয়েকটি বসতঘরেও ঢুকেছে। এ ছাড়া সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের আখিলপুর এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এস এম জাকারিয়া জানান, উপকূলীয় চার উপজেলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। যেসব বেড়িবাঁধ ভেঙেছে সেগুলো মেরামতের জন্য তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
খুলনার পাইকগাছা, দাকোপ ও কয়রা উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি ইউনিয়নের ১৪টি স্থান পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন।
এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মাঝে শিশু খাদ্য, গো-খাদ্যসহ পাঁচশত সাধারণ মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন। সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের মধ্যে সমন্বয় করে পরিস্থিতি মোকাবেলার পরামর্শও দেন তিনি।
পরিদর্শনকালে খুলনার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহাবুব হাসান, সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ইকবাল হোসেন, পাইকগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আনোয়ার ইকবাল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানগণ উপস্থিত ছিলেন।