করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় রাজবাড়ীতে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা ছেড়ে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে আরও অনেকের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার কয়েকটি এলাকায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন চিত্র।
অভিভাবকরা জানান, করোনার কারণে এক বছরের বেশি সময় স্কুল থাকায় অনেকে বাড়িতে পড়াশোনা করছে। যারা একটু সামর্থ্যবান তারা প্রাইভেট শিক্ষক রেখে পড়ছে। তবে দরিদ্র পরিবারের অনেকেই লেখাপড়া বাদ দিয়ে কাজে ঢুকে পড়েছে।
অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে জেলার শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় যুক্ত রাখার উদ্যোগ নেয়া হলেও তা খুব একটা কাজে আসেনি। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীই অনলাইন ক্লাস করতে পারেনি। যাদের ফোন আছে তাদের দু-একজন অনলাইনে ক্লাস করলেও তা অনিয়মিত।
রাজবাড়ী সদরের বেনিনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী শামীম। সে জানায়, বই পেয়েছে। তবে এখনও পড়াশোনা শুরু করেনি। কারণ তাকে পড়ানোর কেউ নেই। তার বাবা-মা পড়াশোনা জানেন না। প্রাইভেট শিক্ষক রাখার সামর্থ্যও তাদের নেই।
বেনিনগর এলাকার রাসেল পড়ত রাজবাড়ী আরএসকে ইনস্টিটিউশন স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। সে এখন একটি জুতার দোকানের কর্মচারী। তার আরেক ভাইও কাজ করে ফলের দোকানে।
মেছেঘাটা গ্রামের দিনমজুর আজিজ মণ্ডলের ছেলে রবিনও পড়ত আরএসকে ইনস্টিউশনে ষষ্ঠ শ্রেণিতে। কয়েক মাস ধরে সে প্রতিবেশী একজনের সবজির দোকানে কাজ করছে।
রবিন জানায়, তার বাবা গরিব মানুষ। স্কুল বন্ধ। তাই বসে না থেকে কাজে ঢুকেছে। স্কুলে বোধহয় তার আর যাওয়া হবে না।
সবজির দোকানের মালিক মন্টু মিয়া বলেন, ‘আমার এখানে কয়েক মাস ধরে কাজ করছে রবিন। ওরা গরিব মানুষ। নুন আনতে পান্তা ফুরায়।’
শহরের আটাশ কলোনির বাসিন্দা দুলাল শেখের ছেলে সাজিদ শেখ পড়ত সপ্তম শ্রেণিতে। সেও পড়াশোনা বাদ দিয়ে রঙের কাজ শুরু করেছে।
শহরের অনেক শিশু শিক্ষার্থীই এভাবে বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ঝরে পড়ছে শিক্ষাজীবন থেকে। শিক্ষা কর্মকর্তা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিয়মিত পর্যবেক্ষণের কথা বললেও বাস্তবে তার খুব একটা প্রভাব দেখা যায়নি।
জেলা শহরের স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক প্রদ্যুৎ কুমার দাস বলেন, ‘গত বছর করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ফেসবুক অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস শুরু হয়েছিল। আমরা এখন জুমেও ক্লাস নিচ্ছি। কিন্তু অনলাইনে ছাত্ররা খুব কমই যুক্ত হয়। শতকরা ২০ থেকে ২৫ ভাগ ছাত্র যুক্ত আছে। আমরা চেয়েছিলাম, সব ছাত্র এতে অংশ নিক। কিন্তু সেটা আর হয়নি।’
মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
আরএসকে ইনস্টিটিউশনের প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ছাত্রদের যখন অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয়, তখন দু-একজন অভিভাবক জানিয়েছিলেন তাদের সন্তানরা কাজে ঢুকেছে। তারা খুবই দরিদ্র। তাদের বলেছিলাম, কাজের পাশাপাশি যেন লেখাপড়াটাও চালিয়ে যায়।’
রাজবাড়ী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিদ্যালয়ের সব শিক্ষককে নির্দেশনা দেয়া আছে, তারা যেন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। শিক্ষার্থীরা যেন পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত থাকে, শিক্ষা কর্মকর্তারা তা পর্যবেক্ষণ করছেন।
‘কিন্তু সমস্যা হলো, যারা দরিদ্র তারা অনলাইন সুবিধা নিতে পারছে না। বিষয়টি নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলব। শিক্ষাজীবন থেকে যেন তারা ঝরে না পড়ে, সে ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেব।’
রাজবাড়ীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মাহবুবুর রহমান জানান, সরকার কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছে, শিক্ষার্থীরা যেন কিছুতেই ঝরে না পড়ে। শিক্ষকদের নিজ নিজ এলাকার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে সচ্ছল ও অসচ্ছলদের ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।