‘জ্যৈষ্ঠ মাস। সময়ডা অইবো দুপুর তিন কি সাড়ে তিনডা। বাইত্তেই আছিলাম। হটাৎ কইরা গুলির শব্দ। ভয় পাইয়্যা গেলাম। কি করুম ভাপতে ভাপতে বাড়িত মেলেটারি ডুইক্যা গেল। জঙ্গলে পলাইছিলাম।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শরীয়তপুরের মধ্যপাড়ায় ২২ মে গণহত্যার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এভাবেই শুরু করেন মহাদেব দাস। ৫০ বছর আগের সেই ভয়াবহ দিনের স্মৃতি এখনও বড্ড বাস্তব তার জীবনে।
ভয়াবহ স্মৃতির সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে আক্ষেপ। গুলিতে আহত হওয়ার পর বেঁচে গেলেও জীবন সংগ্রাম থামেনি। দেশ স্বাধীনের এত বছরও পরও কোনো সরকার তাদের খোঁজ নেয়নি। শুধু ২২ মে আসলেই তাদের খোঁজা হয়।
কথার ফাঁকে চোখ মুছতে মুছতে তাই আক্ষেপ করে বললেন, এখনও জীবন যুদ্ধ চলছে।
শরীয়তপুরের মধ্যপাড়া গণহত্যা দিবস আজ ২২ মে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের বুলেটে এখানে প্রাণ হারান প্রায় ৩০০ মানুষ।
হায়েনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন অসংখ্য নারী। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাটিতে চলে লুট; পুড়িয়ে দেয়া হয় ঘরবাড়ি।
মহাদেব দাস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেলেটারিরা ইচ্ছামত গুলি করে। আমার আপন ভাই, কাকি আর ভাইর ব্যাটা সাথে সাথে মইরা গেল। আমার গায়ে তিনডা গুলি লাগছিল। পইরা রইছিলাম।
‘এইয়ার মইধ্যে কী অইছে জানি না। মুসলমানরা নিয়ে আমারে মুইছ্যা ঠুইছ্যা দিছে। বয়স আমার এহন ৮০ বছর। হেই চিন্নগুলাই লইয়্যা পান সুবারি বেইচ্যা খাই। একটা বয়স্ক ভাতাও পাই নাই। কত মানুষ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা অইল, আর আমরা না খাইয়া মরি।’
ভয়াল সেই স্মৃতি মনে করে এখনও আঁতকে ওঠেন ওই এলাকার মানুষরা। দক্ষিণ মধ্যপাড়ার কার্তিক দাসের স্ত্রী আরতি রানি দাসের বয়স তখন ১৪ কি ১৫ বছর। নিউজবাংলার প্রতিবেদককে দেখে এগিয়ে এলেন।
নিজেই বলতে শুরু করলেন, ‘দুপুর বেলা কাকিরা রানতা (রান্না) ছিল আর মায় বিড়ি বানতাছিল। জোরে একটা আওয়াজ পাইলাম। বাজার তোন বাবা কাকারা আইয়্যা পরল।
‘বাড়ি গর রাইখ্যা আমাগো দেভোগ লইয়্যা গেল। তিন দিন পর আইয়া দেহি লাশ আর লাশ। কুত্তা শিয়ালে খাইতাছে। গন্দে আইগ্যান যায় না। মাডি কাষ্ট করইন্যা মানুষ ছিল না।’
মাদারীপুর জুট মিলে ধরে নিয়ে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয় মধ্যপাড়ার শত শত নারীকে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকেই প্রাণ হারান।
যারা বেঁচে ফিরেছেন তাদের একজন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘হেই দিন রানতে যাইমু। চাউল মাপতে লইছে আর পিছ থিকা গেডি ধরছে। আমাদের তিন বাড়ির মানুষ সব একখানে করছে। এরপর আমাগো দইরা বড় লঞ্চে কইরা নিয়া গেছে। জুট মিলের মইদ্যে চিৎকার আর কানদোন।’
সেই দিনে নিহতদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে মধ্যপাড়া স্মৃতিস্তম্ভ। তুলে ধরা হয়েছে সেই সময়কার নির্মমতার প্রতিচ্ছবি। দেয়ালে খোদাই করা আছে প্রাণহারা মানুষদের নাম। তবে ওইটুকুই। অবহেলায় রয়ে গেছেন প্রাণে বাঁচা মানুষগুলো।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও ক্ষতিগ্রস্তদের খোঁজ নেয়নি কেউ- এমন আক্ষেপ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর। তাদের একজন বিমল দাস। তিনি বলেন, ‘২২ মের দিনটি আমাদের কাছে আতঙ্কের। সেই ৭১ থেকে আজ ২০২১ পর্যন্ত আজও ভুলতে পারিনি সেই দিন।
‘বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে কিন্তু শুধু ২২ মে আসলে আমাদের খোঁজ নেয়া হয়। কিন্তু আজও সরকারের কোনো প্রতিনিধি এসে খবর নেয় নাই। দেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও সেই কষ্ট বহন করতে হচ্ছে এটাই আমাদের আক্ষেপ।’