সাগরে মাছ ধরায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে জেলেদের। কীভাবে সংসার চালাবেন, ঋণই বা শোধ করবেন কীভাবে তা ভেবে পাচ্ছেন না তারা।
মাছ ধরার সঙ্গে বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট অনেকেই ভাবছেন পেশা পরিবর্তনের কথা।
জ্যৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাসকে ধরা হয় ইলিশ ধরার ভরা মৌসুম। জাটকা সংরক্ষণে ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলার পাঁচটি অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ ছিল। এরপর নদীতে মাছ ধরা শুরু হলেও জেলেদের জালে ধরা পড়েনি পর্যাপ্ত ইলিশ।
জেলেরা আশায় ছিলেন ‘ইলশে বৃষ্টি’ তাদের ইলিশের খরা মেটাবে। কারণ এ সময় বৃষ্টি হলে গভীর সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উপকূলের দিকে ছুটে আসতে থাকে। জেলেদের জাল ভরে ওঠে ইলিশ।
কিন্তু গত দুই বছর ধরে এই সময় সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা তাদের হতাশ করেছে।
কুয়াকাটার লতাচাপলি ইউনিয়নের জেলে আলিমুদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘গ্যালোবার থেহে মৌসুমে ইলিশ পাইনা। আর সরকার যে কারণে অবরোধ দেছে হেইয়া মোগো এইহানে নাই। বড় বড় টলার বা জাহাজ হ্যাতো মোগো এইহানে নাই। মোরাতো ধারেই মাছ ধরি। মোগো ক্যানো অবরোধের মধ্যে হান্দাইলো?’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, মেরিন ফিশারিজ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৫ সালে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হলেও ২০১৯ সাল পর্যন্ত শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এ ঘোষণার আওতায় ছিল। কিন্তু ২০২০ সালে ২৫ হাজার স্থানীয় ট্রলার ও নৌকাকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, মূলত হারিয়ে যাওয়া কিছু মাছের প্রজাতির বংশবৃদ্ধির পাশাপাশি সামুদ্রিক ৪৭৫ প্রজাতির মাছের অবাধ প্রজননের জন্যই সাগরে এই অবরোধ দেয়া হয়েছে।
পটুয়াখালীতে ৭০ থেকে ৮০ হাজার জেলে থাকলেও জেলা মৎস্য অফিসে নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৭ হাজার। এর মধ্যে সমুদ্রগামী নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৪৭ হাজার ৮০৫ জন।
নিবন্ধিত প্রতিটি জেলেকে সরকারি খাদ্য সহায়তা হিসেবে ৮৬ কেজি করে চাল দেয়ার কথা জানানো হয়েছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলার জাহাজমারা এলাকার জেলে হুমায়ুন বলেন, ‘৬৫ দিন কোনো মাছ ধরতে পারমুনা বুজলাম কিন্তু খামু কী? সরকার যে চাউল দেয় হে পাইতে পাইতে অনেক সময় লাগে। আবার মোরা যদি পাঁচজন জেলে থাহি দেহা যায় চাউল পাই একজন বা দুইজনে।
‘ধরেন মোর পরিবারে ছয়জন লোক আছে। হের মধ্যে মোরা দুই বাপ-পো হারাদিন সাগরের কিনারে মাছ ধইরা যা পাই হেইয়া বিক্রি কইরা মোরা সংসার চালাই। এহন বিস্সুতবার (বৃহস্পতিবার) অইতে মোরা খামু কী? মোগো সংসার চলবে ক্যামনে? চাউল যদি সরকার দ্যায়ও, হে পাইতে পাইতে আরও পনের হোল দিন লাগবে।’
সাগরে নিষেধাজ্ঞা যে শুধু জেলেদেরই দুর্ভাবনায় ফেলেছে তা নয়, ভাবাচ্ছে ব্যবসায়ীদেরও।
কুয়াকাটার মহিপুর মৎস্য বন্দর ব্যবসায়ী কমিটির সদস্য দিদার উদ্দিন মাসুম জানান, এমনিতেই সাগরে মাছের পোনা কম। তার মধ্যে দুই বছর ধরে দুই দফা লকডাউনে ব্যবসা বাণিজ্য শূন্যের কোটায়। জেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের দাদন দিতে হয়। এদিকে আছে আড়তের স্টাফদের বেতন। সেই সঙ্গে ট্রলার, জাল মেরামত করতে করতে এখন আর হাতে কিছু নেই বললেই চলে।
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার নামকাওয়াস্তে জেলেদের সামান্য কিছু চালের ব্যবস্থা করে। তাও সব জেলেরা এবং প্রকৃত জেলেরা পায় না। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত কোনো মৎস্য ব্যবসায়ীর জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করেনি। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে যে কোনো সময় দক্ষিনাঞ্চলে মৎস্য ব্যবসা বন্ধ হবার আশঙ্কা আছে।’
এদিকে বরগুনা জেলায় মোট নিবন্ধিত জেলে রয়েছে ৩৬ হাজার ২২ জন। তাদের মধ্যে সমুদ্রগামী ২৭ হাজার ২৭৭ জন।
বরগুনার জেলে আফজাল শরীফ বলেন, ‘করোনায় মোগো মেরুদণ্ড ভাইঙা দেছে। হ্যার পর ২২ দিনের ইলিশের অবরোধ, আট মাসের জাটকা ধরার অবরোধ। এখন গাঙ্গে-সাগরেও তেমন মাছ-পোনা নাই। এহন আবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা। ক্যামনে যে বউ-বাচ্চা লইয়্যা বাঁচমু, কইতে পারি না!’
পাথরঘাটা উপজেলার বাদুরতলা গ্রামের জেলে শাহীন মিয়া বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞায় নিষেধাজ্ঞায় মোরা নিঃস্ব অইয়্যা গেছি। সরকারি সহায়তার চাউল দিয়া কি খালি খিদা মেটে, কন? গুরাগারা লইয়্যা জীবনডা বাঁচানই কষ্ট অইয়া যায় মোগো।’
৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা ও করোনাকালের ছুটিতে জেলেদের কতটা ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে, তা জানার জন্য গত বছর ‘সাসটেইনেবল ওশানস’ প্রকল্পের পক্ষ থেকে একটি জরিপের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের সেন্টার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বিভাগ চট্টগ্রামের মহেশখালী ও বরগুনার পাথরঘাটার জেলে ও মাছ ধরার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১ হাজার ৬১ জনের ওপর যৌথভাবে জরিপটি পরিচালনা করে।
জরিপ থেকে জানা যায়, মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ও এর পাশাপাশি অন্য কোনো ধরনের কাজের দক্ষতা না থাকায় জেলেদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দিনমজুরি করতে বাধ্য হন। অন্য এক-তৃতীয়াংশ কর্মহীন অবস্থায় কাটান। বাকিরা বাড়িতে থেকে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফসল ফলান।
করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে যেখানে তাদের পারিবারিক দৈনিক আয় ছিল গড়ে ৩৭১ টাকা সেখানে নিষেধাজ্ঞার সময় তা কমে ১০৭ টাকায় পৌঁছায়।
জেলেদের আয় কমে যাওয়ায় পুষ্টির ঘাটতির বিষয়টি মাথায় রেখে এবার পরীক্ষামূলকভাবে কক্সবাজার অঞ্চলে ৩ হাজার জেলে পরিবারকে আধা কেজি করে শুঁটকি মাছ দেবে আন্তর্জাতিক মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ-বাংলাদেশ প্রকল্প।
ইকোফিশ-বাংলাদেশ প্রকল্পের দলনেতা ও মৎস্য বিজ্ঞানী আবদুল ওহাব নিউজবাংলাকে বলেন, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তটি দেশের মৎস্য সম্পদ, জীববৈচিত্র্য ও মানুষের কল্যাণে করা হয়েছে। তবে সেটা ৬৫ দিনের জন্য প্রয়োজন আছে কি না, সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে তথ্য–উপাত্ত বিচার–বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।’