কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ির কাছে পাঁচতলা একটি কাঠের বাড়ি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এটির নাম রাখা হয়েছে ‘মন ভোলানো কাঠের বাড়ী’। নির্মাতা বলছেন, এটি বানানো হয়েছে মুসলমানদের প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
বিষয়টি স্থানীয় সংস্কৃতিজনদের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
১৮৯১ সালে নদীয়া, পাবনা, রাজশাহী ও উড়িষ্যার জমিদারি তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই সুবাদে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে তিনি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। তার অনেক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচনা হয়েছে এই শিলাইদহে বসে।
কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঐতিহ্যবাহী সেই কুঠিবাড়ির কাছেই বানানো হয়েছে কাঠের বাড়িটি। মাঝগ্রাম এলাকায় ১২ শতক জমির উপর ব্যক্তিমালিকানায় এটি বানানো। সম্পূর্ণ কাঠের তৈরি পাঁচতলা বাড়িটি ৩৫ ফুট উচ্চতার ।
বাড়িটি তৈরি করেছেন স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ জোয়ার্দার। মেঝে ও দেয়ালে রয়েছে নানা কারুকাজ আর রঙিন আল্পনা। নির্মাণকাজে ব্যবহার হয়েছে তাল, মেহগনি আর শাল কাঠ। বিশ্বকবির স্মৃতিবিজড়িত কুঠিবাড়ির কাছে হওয়ায় এখানে প্রতিদিনই ভিড় করছে পর্যটক।
বাড়িটির মালিক স্থানীয় আব্দুর রশিদ জোয়ার্দার বলেন, মুসলমানদের পারিবারিকভাবে পর্যটন বিনোদন দেয়ার জন্য তিনি ‘ইসলামী দৃষ্টিকোণ’ থেকে ২০১৯ সালে এটি নির্মাণ করেন। নির্মাণে ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ইসলামি পার্ক নির্মাণেরও পরিকল্পনা রয়েছে তার। এ ছাড়াও পাশে আরেকটি সাত থেকে আটতলা কাঠের বাড়ি নির্মাণেরও ইচ্ছা আছে তার।
বাড়ির ভেতরে ছবি তুলছেন দর্শনার্থীরা
আব্দুর রশিদ জোয়ার্দার বলেন, ‘দর্শকদের মন জয় করার চিন্তা থেকেই কাঠ দিয়ে বাড়িটি বানানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বাড়ির পাশে মুসলমানদের একটি প্রতিষ্ঠান করলে ভালো হয় – এই ভাবনা থেকেই এটি করা। পাশাপাশি হওয়ায় দর্শনার্থী বেশি পাওয়া যাবে।’
তিনি বলেন, ‘ইসলামিক পার্ক করতে পারছি না অর্থের অভাবে। জায়গা রাখা আছে, পুকুর খনন করা হয়েছে, বাগান করা হয়েছে। কাঠের বাড়ির মধ্যে ইসলামি চিন্তাচেতনার বিভিন্ন প্রদর্শনী আছে। বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার ছবিও রাখা আছে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, পাশে অন্য পার্কও আছে। তবে, মুসলমানদের পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়ানোর জন্য এটা উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়েছে। বাড়ির পরতে পরতে ইসলামি বাণী ও উপকরণ দিয়ে সাজানো হয়েছে।
রশিদ জোয়ার্দারের এই কাঠের বাড়িতে একসঙ্গে ২৫০ থেকে ৩০০ জন লোক উঠতে পারবে। তিনি বলেন, এ ধরনের কাঠের বাড়ি প্রতিনিয়ত রক্ষণাবেক্ষণের মধ্যে রাখতে হয়। কোনো জায়গায় কাঠ দুর্বল হয়ে গেলে বদলে দিতে হয়। এভাবে যুগের পর যুগ টিকে থাকবে এই বাড়ি। তিনি জানান, ২০ টাকা করে প্রবেশের টিকিট নেয়া হচ্ছে। বিক্রি হচ্ছে কারু ও কুটির শিল্প। এ দিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে ভালোভাবেই চলে যাচ্ছে।
পাঁচতলা বাড়ির নিচতলায় রেস্টুরেন্ট আর ওপরে দর্শনার্থীদের সময় কাটাতে খোলা জায়গা রাখা হয়েছে।
তবে, মুসলিম পর্যটকদের জন্য আলাদা করে পাঁচতলা কাঠের বাড়ি নির্মাণ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
দর্শনার্থী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘কারুজ ও সাংস্কৃতিক জিনিসপত্রের সঙ্গে এখানে ইসলামি উপকরণ আছে দেখে ভালো লাগল।'
রহিমা খাতুন বলেন, ‘ফেসবুকে বাড়িটির ছবি দেখে আসলাম। অনেকগুলো ছবি তুললাম। বাড়িটি দেখে ভালো লাগল।’
রবিউল ইসলাম এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি দেখতে। কাঠের বাড়ির নাম শুনে দেখতে আসেন তিনি। কাঠ দিয়েও যে পাঁচতলা বাড়ি করা যায়, তা দেখে তিনি আশ্চর্য। রবিউল বলেন, ‘পর্যটনের উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মাণ করা বাড়িকে ধর্মীয় রং দেয়া ঠিক না। এখানে তো সব ধর্মের দর্শনার্থীই আসবে।’
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ কুষ্টিয়া শাখার সহসভাপতি অধ্যাপক ড. সরওয়ার মুর্শেদ রতন বলেন, ‘এই বাড়ি ঘিরে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে। সবারই বাড়ি করার, পর্যটন কেন্দ্র করার অধিকার আছে। কিন্তু সেই বাড়িটি যদি রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির সঙ্গে তুলনা করে করা হয়, তা খুবই দুঃখজনক।’
ধর্মীয় রং দিয়ে এই পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবসায়িক চিন্তার সমালোচনা করেন তিনি।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠক খলিলুর রহমান মজু বলেন, রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ির ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করছে এমন সকল প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের কোনো ধর্ম নেই। তিনি সার্বজনীন। তিনি কবি, লেখক, গীতিকার। তার বাড়ির পাশে মুসলমানদের জন্য পর্যটন কেন্দ্র করা একটি মৌলবাদী চিন্তা। এ ব্যাপারে শুরু থেকেই সতর্ক হওয়ার তাগিদ দেন তিনি।
এ ব্যাপারে কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘বাড়িটি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের অফিসের সামনে। সামাজিকভাবে বা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো অভিযোগ এলে আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারব। তবে, তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতি প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টি আছে।’