‘হঠাৎ বুধবার রাত ৯টায় মোর ছোডো পোলায় পেটব্যথায় অসুস্থ হইয়া পড়লে পাতারহাটে যাইয়া স্পিডবোট ঠিক করার চেষ্টা করি। বরিশালে যাওয়ার লইগ্গা বোট ড্রাইভাররা প্রথমে ৮ হাজার টাহা চায় মোর ধারে। পরে অনেক দরাদরির পর ৬ হাজার টাহায় যাইতে রাজি হয়। ৯টা দেশি মুরগি ওই রাইতেই এক আত্মীয়র কাছে দিয়া ৬ হাজার টাহা জোগাড় কইরা এরপর বরিশালে আইসা হাসপাতালে ভর্তি করাই। হেয়ানেও তো অনেক খরচা হইছে।’
কথাগুলো বলছিলেন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার দাদপুর এলাকার নারগিস বেগম। পেটব্যথায় কাতর ছেলে ফাহাদকে নিয়ে বুধবার তিনি গিয়েছিলেন জেলা সদরের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এর আগে মুরগি বিক্রি করে স্পিডবোটের জন্য টাকা জোগাড় করতে হয় বলে জানান এ নারী।
নারগিস বলেন, ‘একটা জেলার মধ্যে যাতায়াতে যদি এত খরচা হয় তাইলে বোঝেন যাতায়াতের কী সমস্যা। রাইতে তো বরিশাল টু মেহেন্দিগঞ্জে কোনো লঞ্চও চলে না।
‘অন্য কোনো ব্যবস্থা না থাহায় হাজার হাজার টাহা ভাড়া দিয়া স্পিডবোটে যাওয়া-আওয়া করতে হয় এই এলাকার মানুষগো। আর যে ভোগান্তিতে শেষকালে আমিও পড়ছি।’
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী ভোলা জেলার কয়েক লাখ মানুষকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়। দ্রুত বরিশালে আসতে মানুষ নদীপথে স্পিডবোট ব্যবহার করেন। তবে দিন বা রাতের যেকোনো সময় রোগী নিয়ে আসতে হলে পুরো বোটই ভাড়া নিতে হয় রোগীর স্বজনদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেহেন্দিগঞ্জ থেকে বরিশাল ও বরিশাল থেকে ভোলা রুটে কয়েক শ স্পিডবোট চলে। আর এসব স্পিডবোটে দিনে ৫ থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায় বরিশালে যাতায়াত সম্ভব হলেও সন্ধ্যার পরই স্পিডবোট চালকরা যে যার মতো ভাড়া হাঁকিয়ে থাকেন। কেউ ৬ হাজার কেউ বা ৮ হাজার টাকা নেন।
এত টাকা চাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই জানিয়েছেন, সন্ধ্যার পর যারা মেহেন্দিগঞ্জ বা ভোলা থেকে বরিশালে আসেন তারা সবাই জরুরি কাজ অথবা রোগী নিয়ে আসেন। এ কারণে ইচ্ছামতো ভাড়া চাইলেও তারা তা দিতে বাধ্য হন।
ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার শশীগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা জুয়েল হাজরা জানান, টমটম দুর্ঘটনায় জানুয়ারি মাসে তার বাবার পা ভেঙে যায়। এরপর ভোলা হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানকার চিকিৎসক বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিতে বলেন। চিকিৎসা করানোর টাকা না থাকায় জমি বিক্রি করেন। সেই টাকা নিয়ে বরিশালের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে ভেদুরিয়া ঘাটে যান। ঘাটে স্পিড বোট ভাড়া করতে গিয়ে রীতিমতো বোকা হতে হয়েছে তাকে। বরিশাল যেতে তার কাছে ভাড়া চাওয়া হয় ৬ হাজার টাকা।
‘সিন্ডিকেট করে স্পিড বোট চালকরা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে। এরপর টাকা ইনকাম করে দেদারছে। কোনো মানবিকতা নাই। রোগী নিয়ে আসলে এরা ভাড়া কয়েক গুণ বাড়িয়ে বলে। এটার স্থায়ী সমাধান দরকার।’
বরিশাল থেকে ভোলা রুটের স্পিডবোট চালক সিদ্দিকুর বলেন, ‘বরিশালের ড্রাইভাররা কেউ এত ভাড়া রাহে না। এই কাম করে ভোলা আর মেহেন্দিগঞ্জের ড্রাইভাররা। ওগো নেতা, পুলিশ অনেক কিছু ম্যানেজ কইরা আওয়া লাগে তো। এর লইগ্গা এত ভাড়া রাহে।’
বরিশালের গবেষক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, ‘স্পিডবোট চালানো নিয়ম এবং নির্দিষ্ট ভাড়ার মধ্যে আনা উচিত। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা ও ভোলা জেলার পুরোটাই নদীবেষ্টিত। তা ছাড়া এখানকার বাসিন্দারা অর্থনৈতিকভাবে তেমন স্বচ্ছল নয়। কেউ অসুস্থ হলে কয়েক হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে বরিশালে আসতে হয়।
‘অনেকে জমি বিক্রি করে, কেউবা ধার-দেনা করে চিকিৎসা নিতে আসে বরিশালে। এসব এলাকার মানুষদের যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ করা দরকার। রোগী বহনের জন্য ভোলার কয়েকটি উপজেলা এবং মেহেন্দিগঞ্জে যদি কিছু স্পিডবোট দেয়া হয় তাহলে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে।’
এ বিষয়ে বরিশালের জেলা প্রশাসক (ডিসি) জসীম উদ্দিন হায়দার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের খবরে আমরা প্রায়ই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকি। তবে স্পটে বসে যাত্রীরা সত্যি কথা বলতে চায় না।
‘কঠোর নজরদারি রয়েছে স্পিডবোট ঘাটগুলোতে। পাশাপাশি রোগীদের যাতায়াত সহজ করতে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।’
বরিশাল ৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ নাথ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেহেন্দিগঞ্জের রোগী বরিশালে নেয়ার জন্য একটি বোট রয়েছে। তবে সেটা অচল। ডিজেল ইঞ্জিন এবং ধীরগতির হওয়ায় সেটা রোগীর স্বজনরা ব্যবহার করেন না।’
তিনি বলেন, ‘মেহেন্দিগঞ্জ সদরের মানুষ প্রয়োজনে ভাড়া বেশি দিয়ে হলেও দ্রুত বরিশাল যেতে পারেন। কিন্তু ভাসানচর, শ্রীপুর, আলিমাবাদ, গোবিন্দপুরসহ আরও কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ যদি অসুস্থ হয়ে বরিশালে যেতে চায়, তাহলে তাদের নেয়াটা রীতিমতো যুদ্ধের সমান। সেটা আর বলার অবকাশ রাখে না।
‘ভয়ানক নদী পাড়ি দিতে হয় তাদের। আমার এলাকার মানুষদের সুবিধার্থে রোগী পরিবহনে একটি দ্রুত গতির স্পিডবোট আনার চেষ্টা চলছে।’