‘মাইয়াডা মইর্যা গ্যাছে, তিন তিনডা গুড়াগারা থুইয়া। চা বেইচ্চা নিজেরা চলি, নাতি-নাতকুর তিনডা পালি। জোডাইতে পারলে খাইম, না জোডলে না খাইয়া থাহি। প্যাডের ভাতই তো জোডে না, ঈদ করমু কী দিয়া, মোগো কফালে ঈদ নাই।’
বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকখালী খেয়াঘাট এলাকায় ছোট্ট একটি ঘরে পরীভানুর চায়ের দোকান। কাঠের আগুনের মাটির উনুনের উপরে বসানো কেটলির নালা দিয়ে ঘন বাষ্প উড়ছে। কয়েকটি পলিথিনে ঝুলছে কেক ও বিস্কুটজাতীয় শুকনো খাবার। কাচের কাপে কেটলির গরম পানিতে টুংটাং শব্দে চা তৈরি করেন পরীভানু।
খেয়াঘাটে অপেক্ষমাণ যাত্রীরা এই দোকানে বসেন, চা পান করেন। পাশে সরকারি আশ্রয়ণ ও আবাসন প্রকল্পের ঘর। ওই ঘরের বাসিন্দারাও এখানে আসেন, বসে চা পান করেন, গল্প করেন।
পরীভানুর জীবনের গল্পটা ছিল গ্রামের আর পাঁচ-দশটা নারীর মতো। স্বামী পনু মিয়ার সঙ্গে সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের ছোট পোটকখালী এলাকায় বসবাস করতেন। জমিজমা না থাকলেও স্বামী পনু সাগরে মাছ ধরতেন, এতেই দিব্যি কেটে যেত সংসার।
একদিন স্বামী পনু সাগরে মাছ ধরতে যান। সাল ২০০৭। আঘাত হানে ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডর। ট্রলারডুবিতে সাগরে তলিয়ে যান পনু। আট দিন সাগরে ভেসে ভারতের জলসীমায় চলে গিয়ে আটক হন।
নিখোঁজ পনুর অপেক্ষায় দিন কাটে পরীভানুর। দুই বছর পর জেলেদের সহায়তায় ফিরে আসেন তিনি। কিন্তু সাগরের নোনাজলে হাত-পায়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়। কাজ করার মতো শক্তি-সামর্থ্য হারান তিনি। পরে খেয়াঘাটের এই জমিটুকুতে ঘর তুলে শুরু করেন বসবাস।
অবশ্য এর আগে বিয়ে দেন একমাত্র মেয়ে তাজনেহার। তার ঘরে আসে তিন সন্তান। কিন্তু বছর কয়েক পর স্বামীর নির্যাতন শুরু হয়। বিষপান করে ‘আত্মহত্যা’ করেন তাজনেহার। তিন শিশুর লালন-পালনের দায় চাপে নানি পরীভানুর ওপর।
সুমাইয়া, তাহসিন, তাসফিয়া তিনজনই নানির সঙ্গে এখানেই বসবাস করে। এর মধ্যে তাহসিনকে শেখ রাসেল পুনর্বাসন কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছে। সুমাইয়া স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে আর তাহসিন প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে।
তিন নাতি আর অচল স্বামীর ভরণপোষণ চলে এই চা দোকানের রোজগার থেকে।
‘ঈদ আইলেই নাতি-নাতনিরা জ্বালা শুরু হইর্যা দেয়, নানি জামা কাফুর কিন্না দেও। ওগো কেমনে বুজামু মোরদারে টাহা নাই। ওগো মোহের (মুখের) দিগে চাইলে মোর পরানডা কাইন্দা ওডে। কী হরমু বাবা কন, নিজেগো প্যাডই চলে না, ঈদে জামা কিনমু কিইদ্দা’।
চোখ ছলছল করে ওঠে পরীভানুর। তার মতো অবস্থা পোটকাখালী আশ্রয়ণের বাসিন্দাদের অনেকেরই।
আবদুল লতিফের বয়স নব্বইয়ের কোটা ছুঁয়েছে। আশ্রয়ণে ঘর জুটেছে, তবে এই বয়সে এসেও খাবার জোটে না তিন বেলা। ঘরে রোগাক্রান্ত স্ত্রী, সন্তান নেই তার। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে দরিদ্র ঘরে।
দিনভর মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে যা জুটত তা দিয়ে চাল-ডাল কিনে দুবেলা-দুমুঠো জোটাতে পারতেন। কিন্তু করোনার জন্য এখন সেই পথও বন্ধ।
‘এই বয়সে কামকাইজ হরতে পারি না, গায় বল পাই না। দুগ্গা খাইয়া যে রোজ রাকমু হেইরহম কোনো খাওনই ঘরে নাই বাবা। মাইনসে ডাইক্কা দুগ্গা খাওয়াইলে খাই। না খাওয়াইলে না খাইয়াই থাহি’ বলছিলেন লতিফ।
শুধু লতিফ নন, আশ্রয়ণের বাসিন্দা রঞ্জু মিয়া, সত্তার সিকদার, আলী হোসেন, আবদুল খালেক, পনু মিয়া, নান্টুসহ অন্যদেরও জীবনের গল্পটা এখানে এমনই। এদের প্রত্যেকের বয়স ৭০ বছরের ঊর্ধ্বে।
সুলভ মূল্যের (১০ টাকা কেজি দরে) তালিকায় নাম আছে তাদের। যে কারণে অন্তত হাঁড়িতে সিদ্ধ চালের ভাতের জোগান হয়। তবে ঈদের সময় নতুন কাপড় আর পাঞ্জাবি টুপি পরে জায়নামাজ নিয়ে ঈদগাহে যাওয়া হয় না।
বায়নাও নেই নতুন কাপড়ের, পুরোনো জোড়াতালির কাপড় পরেই আদায় করেন ঈদ। তবুও বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট।
খেয়াঘাটের পরীভানুর চায়ের দোকানে বসে এইসব মানুষের গল্প শুনতে শুনতে বেলা গড়ায়। পরীভানু কিংবা লতিফদের এমন একটা জীবন বয়ে বেড়ানোর অথবা জীবন সায়াহ্নে এসে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটানোর কথাগুলো মনে দাগ কাটে।