এক দশকের বেশি সময় দখল-দূষণে ধুঁকছিল কুমিল্লার গোমতী নদী। চরের জমি হারিয়ে পেশা পাল্টেছেন অনেক কৃষক। প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নজরদারি না থাকায় দখলদারদের দেদার মাটি কাটা ও বালু তোলায় প্রাণহীন হয়ে পড়েছিল গোমতী।
এবড়োখেবড়ো গোমতীর বুকে ছিল না পানির প্রবাহ। মৃতপ্রায় নদীটি নিয়ে কত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। তবু টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের।
দীর্ঘ সময় পর এবার কঠোর হয়েছে জেলা প্রশাসন। বন্ধ করা হয়েছে গোমতীর মাটি কাটা। দুই মাস দিনরাত চলছে অভিযান। উচ্ছেদ করা হয়েছে গোমতীর দুই পারের অবৈধ দখলদারদের।
প্রশাসনের এমন উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন গোমতীচরের কৃষকরা। কৃষকদের প্রত্যাশা এবারের বর্ষায় গোমতী ফিরে পাবে তার হারানো যৌবন। কলকল শব্দে এর বুকে বইবে পানি। সবুজে ভরে উঠবে গোমতীর বিস্তীর্ণ চর।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের কুমিল্লা শাখার সাধারণ সম্পাদক আলী আকবর মাসুম জানান, প্রতিবছর গোমতীর বালুমহালের ইজারায় রাজস্ব পায় সরকার। তবে মাটি কাটার কোনো নিয়ম নেই। শুষ্ক মৌসুমে দিনরাত সমানে কাটা হতো গোমতীর চরের মাটি। লাখ টাকায় বিক্রি হতো। তবে মাটি কাটায় কোনো রাজস্ব পেত না সরকার। এক যুগ ধরে নদীর চরে চলছিল হরিলুট।
গোমতী নদী বাঁচাতে জেলা পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস এখন প্রশাসনকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা দিচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাইদ জানান, অভিযানে গোমতীতে অবৈধভাবে মাটি কাটা ও বালু তোলার অভিযোগে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে আটজনের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও বালু তোলায় ব্যবহৃত পাঁচ হাজার ফুট পাইপ অপসারণ করা হয়।
গোমতী নদীর চর ঘুরে দেখা যায়, চরজুড়ে দখলদার ও মাটি কাটার চিহ্ন। নদীর চরের যেসব জায়গায় কৃষকরা রবিশস্য উৎপাদন করতেন, সেসব জায়গা পুকুর-ডোবায় পরিণত হয়ে আছে। বেড়িবাঁধপাড়ের গাছগুলো ধুলাবালিতে চাপা পড়ে আছে।
তবে প্রশাসনের অভিযানে গোমতী নদীর কোথাও নজরে পড়েনি মাটি কাটার দৃশ্য। কৃষকরাও চরে ফিরতে শুরু করেছেন।
এতে খুশি গোমতী চরে চাষবাস করা অন্তত ষাট হাজার কৃষক।
চরের আদর্শ সদর উপজেলার অংশের শাহাপুর এলাকার কৃষক শফিক মিয়া বলেন, ‘যে যেমনে পারছে মাডি কাটছে। গত চাইর-পাছ বছর ধইরা আমডা চরে মইধ্য আলু, বাইগন, ফুল কফি, বান্ধা কফি লাগাইতাম পারতাছি না। তিন-চাইর বছর ধইরা শাওন মাসেও নদীত পানি আইয়ে না। চরের মাডিডি কাইট্টা লইয়া গেছে।
‘এবার প্রশাসন ট্রাক্টরটিরে ধরছে। কয়ডা মানুষরেও ধরছে। অহন আর দিনে রাউতকা আর মাডি কাডে না। মনে অইতাছে এবার চাষ করতাম পারাম। পানিও আইব নদীত।’
তবে অভিযান হচ্ছে নদীর সদর উপজেলার অংশে। পুরো গোমতী নদীতে অভিযান পরিচালনা করা দরকার বলে মনে করছেন গোমতীপারের কৃষকরা।
বুড়িচং উপজেলার শিমাইল খাড়ার কৃষক মোতালেব মিয়া বলেন, ‘শুধু সদরে না, পুরা গোমতীর ভিত্তরে অভিযান অইলে বালা আছিল। বুড়িচং, দেবিদ্বারেও যে যেমনে পারতাছে মাডি কাডতাছে।’
কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মিজানুর রহমান জানান, গোমতী নদীর চরের অন্তত এক হাজার হেক্টর জমিতে পাঁচ হাজার কৃষক চাষাবাদ করত। তবে গত পাঁচ বছরে দখলদারদের কারণে জমি কমেছে সাড়ে ৩০০ হেক্টর।
তিনি আরও বলেন, অন্তত এক হাজার কৃষক পেশা বদল করেছেন। জেলার অন্তত ২৫ ভাগ সবজি সরবরাহ হয় এই গোমতী নদীর তীর থেকে। তবে এখন প্রশাসন সোচ্চার হওয়ায় আশা করা যায় গোমতী তার পুরোনো রূপ ফিরে পাবে। কৃষকরাও ফিরবে চরে।
গোমতী নদীতে অভিযানের বিষয়ে কুমিল্লার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, ‘আমি সম্প্রতি কুমিল্লায় যোগ দিয়েছি। এরপরই কুমিল্লার বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সভা-সমাবেশ করেছি... অবৈধভাবে গোমতী নদীর মাটি কাটা ও বালু উত্তোলন বেশ বড় একটি সমস্যা হিসেবে সবাই উপস্থাপন করে। আমি নিজেও রাতের বেলা নদীর বিভিন্ন স্থানে গিয়েছি।’
তিনি জানান, গোমতী নদীর দখল-দূষণরোধে গত দুই মাস অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। অভিযানে ৫৩টি ড্রেজার মেশিন, ২২ ড্রাম ট্রাক, ৬টি ট্রাক্টর, ২টি ভেকু মেশিন জব্দ করা হয়।
ডিসি বলেন, ‘গোমতীকে বাঁচাতে আমরা যে অভিযান পরিচালনা করছি, তা ৮০ ভাগ সম্পন্ন করেছি। গোমতীতে এত দিন যারা দখল করে বালু ও মাটি উত্তোলন করেছিল তারা ভেবেছিল এ অভিযান নামমাত্র। তবে তারা জানে না কুমিল্লা প্রশাসন এসব অবৈধ দখলদারদের চিরতরে উচ্ছেদ করে তারপরই অভিযান শেষ হবে।’