গৃহবধূকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় থানা মামলা না নেয়ায় মরদেহ সমাহিত না করে প্রতিবাদ করছিল একটি পরিবার। তাদের এমন প্রতিবাদের মুখে পরে পুলিশ মামলা নেয়। আর মরদেহটি সমাহিত করা হয়।
ঘটনাটি ঘটেছে নওগাঁ সদরে।
নওগাঁয় জমিজমা নিয়ে বিরোধের জেরে ওই গৃহবধূকে গায়ে আগুন দিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠে। তাকে আগে থেকেই হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল। তিনি থানায় অভিযোগও করেছিলেন।
ভুক্তভোগী রিতা নওগাঁ সদর উপজেলার শৈলগাছী ইউনিয়ন এর চক-চাপাই গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের স্ত্রী।
নওগাঁর এই নারী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বগুড়ার একটি হাসপাতালে। এরপর নওগাঁ থানায় মরদেহ নিয়ে আসার পর পুলিশ বগুড়ায় সুরতহাল প্রতিবেদন হয়েছে বলে সেখানে মামলা করতে বলে।
ক্ষুব্ধ পরিবারটি মরদেহ নিয়ে দাফন না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা জানায়, পুলিশ আইনি ব্যবস্থা নিলেই তারা সমাহিত করবেন নিহত রিতা বেগমকে।
ছয় ঘণ্টা এভাবে রাখার পর পুলিশ মামলা নেয়।
হত্যার হুমকি
মোসলেম উদ্দিনের ভাই ও ভাতিজাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। এরই জেরে গত ২৪ এপ্রিল রাত ১০টার দিকে রিতা বেগমকে হুমকি দেয়া হয়।
এ সময় মোসলেন উদ্দিন প্রামাণিক ঘরে ঘুমিয়েছিলেন। ঘুম ভাঙলে রিতা তাকে বিষয়টি জানালে ২৯ এপ্রিল চারজনের নাম উল্লেখ করে থানায় লিখিত অভিযোগ করেন তিনি।
মোসলেম যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দেন তারা হলেন তার ভাতিজা আলামিন প্রামাণিক, আলামিনের মা সাগিদা বেগম, মোসলেমের চাচাত ভাই সানোয়ার প্রামাণিক ও জলিল প্রামাণিক।
পরদিন রাত একটার দিকে উঠানে থাকা শৌচাগারে যান রিতা। ফেরার পথে চার থেকে পাঁচজন গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।
রিতার চিৎকারে মোসলেম উদ্দিনসহ প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসে। আর হামলাকারীরা পালিয়ে যায়।
গায়ের আগুন নেভাতে রিতা বেগম পুকুরে গিয়ে ঝাঁপ দেন। পুকুর থেকে তাকে তুলে নওগাঁ সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে মারা যান রিতা।
মরদেহ নিয়ে সরাসরি থানায়
শনিবার বিকেল তিনটার দিকে মরদেহ নওগাঁ সদর মডেল থানায় নেয়া হয়। থানা থেকে মরদেহটি দাফন করতে বাড়িতে নিতে বলা হয়। কিন্তু সেটি দাফন না করে বাবার বাড়ি সদর উপজেলা গাংজোয়ারে রাখা হয়েছে।
মামলা ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ না করা পর্যন্ত মরদেহ দাফন করা হবে না জানিয়ে ন্যায়বিচার দাবি করেন নিহতের পরিবার।
মোসলেম উদ্দিন জানান, বাড়ির দেড় কাঠা জায়গা নিয়ে বিরোধ চলছিল ভাই-ভাতিজাদের সঙ্গে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রিতাকে হুমকি দেয়া হয়। আলামিন সেদিন তার স্ত্রীকে বলেন, পাঁচ দিনের মধ্যে জায়গা ছেড়ে না দিলে তাকে ও রিতাকে মেরে ফেলা হবে। থানায় অভিযোগ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।
তিনি জানান, মারা যাবার আগে রিতা তার ওপর হামলাকারী হিসেবে চারজনের নাম বলে গেছেন।
মোসলেম বলেন, ‘যতক্ষণ না মামলা ও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হবে ততক্ষণ আমরা লাশ দাফন করব না।
‘আমার ১৬ বছরের এক মেয়ে ও আট বছরের ছেলেকে নিয়ে কীভাবে চলব? কী সান্ত্বনা দেবো তাদের?’
নিহত রিতা খাতুনের মেয়ে আরিফা ইয়াসমিন বলেন, ‘মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে মা একটু একটু কথা বলতে পারত। মারা যাবার আগে চারজনের নাম বলে গেছে, যে তারাই গায়ে আগুন দিয়েছে।’
রিতার মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘তিন বছর আগেও সানোয়ার ও জলিল নামে দুইজন আমার মেয়েকে মেরেছিল। আমি মেয়ে হত্যার বিচার চাই।’
পরিবারটি যে চারজনের নামে অভিযোগ আনছে, তাদের বাড়িতে গেলে কাউকে পাওয়া যায়নি। বাড়িতে তালা ঝুলানো রয়েছে। মোবাইল ফোনও বন্ধ।
পুলিশ কী বলছে?
নওগাঁর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জুয়েল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে নিহত রিতা বেগম থানায় অভিযোগ করেছিলেন। তার পরদিন রাতেই গৃহবধূর গায়ে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যালে শুক্রবার সন্ধ্যার দিকে মারা যায়।’
তিনি বলেন, ‘আজ থানায় মরদেহ নিয়ে আসলে আমরা পরিবারের সদস্যদের বলি, যেহেতু মরদেহটির সুরতালহাল প্রতিবেদন বগুড়াতে করা হয়েছে তাই মরদেহ দাফন করা হোক।’
মরদেহটি সমাহিত না করার বিষয়ে জানেন কি না- এমন প্রশ্নে ওসি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি জানার পর সঙ্গে সঙ্গে বিকেলে পুলিশ পাঠিয়েছিলাম কিন্তু অভিযুক্তদের কাউকেই বাড়িতে পাওয়া যায়নি। পরিবারের পক্ষে নিহতের মা রেকেয়া বেগম মামলা করবেন। মামলার প্রস্ততি চলছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
ছয় ঘণ্টা পর মামলা রেকর্ড
পরিবারটির অনমনীয় অবস্থান দেখার পর অবশেষে রাতে মামলা নিতে রাজি হয় নওগাঁ থানা। রিতার মা রোকেয়া বেগমের করা ওই মামলায় আসামি করা হয় মোসলেম উদ্দিনের ভাতিজা আলামিন প্রামাণিক, তার মা সাগিদা বেগম, মোসলেমের চাচাত ভাই সানোয়ার প্রামাণিক ও জলিল প্রামাণিক।