দুই মাসের নিষেধাজ্ঞার পর শুক্রবার মধ্যরাত থেকে দেশের ছয়টি অভয়াশ্রমে ইলিশ ধরতে নামবেন জেলেরা। তবে সরকারি আদেশ মেনে মাছ ধরা থেকে বিরত থাকলেও প্রনোদনা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন অনেকে।
ইলিশসহ অন্যান্য মাছের উৎপাদন বাড়াতে মার্চ-এপ্রিল দুই মাসব্যাপী দেশের ছয়টি অভয়াশ্রমে সকল ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল।
এই দুই মাস নৌকা তৈরি, মেরামত ও জাল বোনাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত ছিলেন জেলেরা। এখন নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ায় মাছ ধরতে নামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা।
ভোলায় মৎস্য বিভাগের নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১ লাখ ৪০ হাজার। তবে নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে আরও পায় ২ লাখ জেলে। এদের অধিকাংশই নিষিদ্ধ সময়ে মাছ শিকারে নামেনি।
জেলেদের দাবি, তারা মাছ ধরা থেকে বিরত থাকলেও এক শ্রেণির অসাধু জেলে ও ব্যবসায়ী চাপিলা নামে পরিচিত কোটি কোটি ইলিশের বাচ্চা ধ্বংস করে ফেলেছে।
তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম আজহারুল ইসলাম দাবি করেন, বিপুল পরিমাণ ইলিশের বাচ্চা ধ্বংসের পরও দুই মাস মাছ শিকার বন্ধ থাকায় বর্ষায় জেলেরা এর সুফল পাবে।
মধ্যরাত থেকে পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ ধরতে নামবেন চাঁদপুরের জেলেরা। জালে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়বে এমন আশা তাদের।
ইলিশ ধরার অপেক্ষায় রয়েছে জেলে নৌকা। ছবি: নিউজবাংলা
দুই মাসের নিষেধাজ্ঞায় জেলার মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল থেকে হাইমচর উপজেলার চরভৈরবী পর্যন্ত পদ্মা-মেঘনা নদীর ৭০ কিলোমিটার এলাকায় সকল ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল।
২০০৬ সাল থেকে মার্চ-এপ্রিল দুই মাস চাঁদপুরের বিস্তীর্ণ নদীসীমাকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করে জাটকা রক্ষা কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এ সময়ে নদীতে মাছ ধরা, পরিবহন, বিক্রি ও মজুত সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার।
সদর উপজেলার হরিণা ফেরিঘাট, বহরিয়া, রনগোয়াল, পুরানবাজার, আনন্দ বাজার এলাকার জেলেপল্লিগুলো ঘুরে দেখা যায়, জেলেরা ইলিশ ধরার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সদর উপজেলার আনন্দ বাজারের জেলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই নদীতে মাছ ধরা ছাড়া অন্য কোনো কাজ শিখি নাই। তাই নিষেধের সময়টা আমাদের কষ্টে কেটেছে। নদীতে না যেতে পারায় আয়ও বন্ধ ছিল। ধারদেনা করে ঋণের বোঝাও বেড়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের বহরিয়া এলাকার এক জেলে বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময় ৪০ কেজি করে চাল দেয়ার কথা থাকলেও আমরা ২৫ থেকে ৩০ কেজি করে চাল পেয়েছি। এ ছাড়া অনেক অসাধু জেলে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে নদীতে নেমে নির্বিচারে জাটকা ধরেছে। এতে করে ইলিশ পাওয়া নিয়ে আমরা শঙ্কিত। ’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুল বাকী বলেন, ‘স্বল্প জনবল নিয়েও প্রশাসন জাটকা রক্ষায় নিরলস কাজ করেছে। মৎস্য বিভাগ, জেলা প্রশাসন, নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড দিন-রাত পালাক্রমে নদীতে অভিযান চালিয়েছে। এরপরেও কিছু অসাধু জেলে নদীতে জাটকা শিকার করেছে। তারপরেও আমাদের অভিযান সফল হয়েছে বলে মনে করছি।’
তিনি বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার দুই মাসে পদ্মা-মেঘনায় মোট ৫৭৫টি অভিযান চালানো হয়। এতে প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ মিটার কারেন্ট জাল, ৩৮.৬৬ মেট্রিকটন জাটকা জব্দ করা হয়। অভিযানে ২৯০ জন জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও প্রায় ৪০০ জেলেকে জরিমানা করা হয়েছে।’
ইলিশ ধরার আগে জাল মেরামতে ব্যস্ত জেলেরা। ছবি: নিউজবাংলা
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাঁদপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, গত বছর দেশে সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হলেও আশা করি এ বছর রেকর্ড ভেঙে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হবে।’
ইলিশ শিকারে মেঘনা নদীতে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন লক্ষ্মীপুরের জেলেরা। অবসরে ঠিক করে নিয়েছেন জাল-নৌকাসহ মাছ ধরার বিভিন্ন উপকরণ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন জানান, সরকার ঘোষিত দুই মাস মা ইলিশ রক্ষায় জেলা টাস্কফোর্স তৎপর ছিল। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে মা ইলিশ রক্ষায় নির্ধারিত সময় শেষ হচ্ছে। লক্ষ্মীপুরের জেলেরা ফের নদীতে মাছ ধরতে নামতে পারবেন।
মাছ ধরার সকল প্রস্তুতি নিয়েছেন পটুয়াখালীর ২৭ হাজার জেলে। দেশের পাঁচটি অভয়াশ্রমের একটি তেতুলিয়া নদীর পটুয়াখালী অংশের ৬৫ কিলোমিটার এলাকার এসব জেলে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে মাছ ধরতে নামবেন।
এক মাস ধরে তেতুলিয়াসহ জেলার অধিকাংশ নদীর পানি লবণাক্ত হওয়ায় মিঠা পানির মাছ কম পাচ্ছেন জেলেরা।
জেলে হোসেন আলী মিয়া নিউজবাংলাকে জানান, ‘দুই মাস ধইরা ঘরে বইয়া রইছি। কোনো কামকাজ ছিল না। ঘরে বাজারও নাই, চলতে অনেক কষ্ট অইছে। ধারকর্য কইরা এই কয়দিন চইলছি। রাইতে নাম্মু নদীতে, মাচ পাই কিনা জানি না। নদীতে এ বছর নুন পানি। এতে মাচটাচ পরে কিনা জানি না।’
জেলা সিনিয়র মৎস্য অফিসার মোল্লা এমদাদুল্লাহ জানান, নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরা থেকে পুরোপুরি বিরত ছিলেন পটুয়াখালীর ২৭ হাজার জেলে। এর মধ্যে নিবন্ধিত ২০ হাজার জেলেকে সরকারি খাদ্যসহায়তা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘গত দুই মাসে ১২০টি অভিযানে এক টন জাটকা জব্দসহ ১৫টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। নদীতে লবণ ঢোকায় ইলিশ ছাড়া অন্য মাছের প্রজননে বাধা সৃষ্টি হয়েছে।’
নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় কর্মচঞ্চলতা ফিরেছে শরীয়তপুরের পদ্মাপাড়ের জেলে পল্লিতে। করোনা মহামারিতে আর্থিক লোকসানের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার আশা জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীদের।
ইলিশ ধরার আগে নৌকা মেরামত করছেন জেলেরা। ছবি: নিউজবাংলা
জেলা মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত শরীয়তপুরের নড়িয়ার পদ্মা নদীর পাঁচ কিলোমিটার এলাকা এবং ভেদরগঞ্জের ১৫ কিলোমিটার এলাকায় সব ধরনের জাল ফেলার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। শুক্রবার মধ্যরাত থেকে এই নিষেধাজ্ঞা উঠে যাচ্ছে।
নিষেধাজ্ঞার সময় নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ১২৭টি অভিযান চালিয়েছে মৎস্য বিভাগ। এর মধ্যে ২৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালতে ১৩৭টি মামলা, ৬ লাখ ৩৬ টাকা জরিমানা ও তিন জেলেকে এক বছর করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ৩ দশমিক ৮১ মেট্রিকটন জাটকা ও ১০ লাখ ৭৩ হাজার মিটার জাল জব্দ করা হয়েছে।
১ মে থেকে নদীতে ইলিশের অভয়াশ্রমের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও জাটকা ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে জুন পর্যন্ত। এ সময় নদীতে সব ধরনের অবৈধ জাল ফেলা নিষিদ্ধ।
জেলার সুরেশ্বর থেকে তারাবুনিয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ২৫ কিলোমিটার পদ্মা-মেঘনা পাড়ের দেড় শতাধিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে মাছ বেচা-বিক্রির প্রস্তুতি সেরে রাখা হয়েছে।
সুরেশ্বরের জেলে শাহ আলম বলেন, ‘কালই কো থিক্কা আরা কোনো বাধা থাকবো না। নদীতে নামনের সব কাজ শেষ। অনেক দেনা পানা হইছি, এখন মাছ ধরইরা হেইয়া শোদ করুম। সামনে ঈদ এই দশ পনোরো দিনে কী কইরা দেনা দিমু আর পোলাহানের জামাকাপড় কিনুম আল্লাহ জানে।’
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুবোধ কুমার বলেন, ‘অভিযান সফল হয়েছে। এতে সব ধরনের মাছের বংশ বৃদ্ধি হয়েছে এবং আকারে বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। প্রতি বছর এই অভিযান পরিচালিত হওয়ায় দেশে মিঠা পানির মাছের উৎপাদন বেড়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ইলিশের অভয়াশ্রম অভিযান শেষ হলেও ৩০ জুন পর্যন্ত জাটকা নিধন বন্ধে অভিযান থাকবে। তবে নদীতে বৈধ জাল ফেলায় নিষেধাজ্ঞা থাকবে না।’