বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

‘প্রতারণা করে’ বিত্তশালী

  •    
  • ২৯ এপ্রিল, ২০২১ ১৩:৫৩

কর্মজীবনের শুরুটা হোটেল বয় হলেও এখন বিত্তশালী। বিয়ে করেছেন দুটি। বামনার আমতলী গ্রামে দুই স্ত্রীর জন্য দুইটি দ্বিতল বাড়ি করেছেন। এই বাড়ি দুটি করতে যে অঢেল খরচ হয়েছে, সেটি দেখলেই বোঝা যায়।

কখনও সাংবাদিক, কখনও গোয়েন্দা কর্মকর্তা, কখনও বা আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী বা কোনো উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। যখন যার কাছে যে পরিচয় দিলে সুবিধা, সেটিই দেন তিনি।

এমন বহুরূপী চরিত্রের নাম আবদুস সালাম। বাড়ি বরগুনার বামনা উপজেলা সদর ইউনিয়নের দক্ষিণ আমতলী গ্রামের বান্ধাকাটা এলাকায়।

সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন ঢাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী। বরগুনায় তার খোঁজে এসে ব্যবসায়ীরা জানান, অটো পার্টস বিক্রিকে পেশা দেখিয়ে অনেকের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন সালাম। তবে তাকে এখন পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও।

কর্মজীবনের শুরুটা হোটেল বয় হলেও এখন বিত্তশালী। বিয়ে করেছেন দুটি। বামনার আমতলী গ্রামে দুই স্ত্রীর জন্য দুইটি দ্বিতল বাড়ি করেছেন। এই বাড়ি দুটি করতে যে অঢেল খরচ হয়েছে, সেটি দেখলেই বোঝা যায়।

বাবা-মা মারা গেছেন অনেক আগেই। একটিতে এক স্ত্রী ও তার দুই ছেলে থাকেন, আরেকটি খালি থাকে। দ্বিতীয় স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি ঢাকায় থাকেন।

বিভিন্ন সময়ে তিনি ছিনতাই, চুরি ও প্রতারণার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন অনেকবার। জামিনে মুক্তি পেয়ে তিনি আবার শুরু করেন নতুন নতুন ফন্দি।বামনা সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান চৌধুরী কামরুজ্জামান সগীর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সালামের বিরুদ্ধে এলাকায় বেশ কয়েকটি চুরির অভিযোগ রয়েছে। ২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে বামনা থানায় চুরির অভিযোগে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় মাসখানেক জেল খাটার পর এরপর তিনি এলাকা ছাড়েন।

‘শুনেছি ঢাকায় হোটেলে চাকরি ও পরে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের কাজ করতেন। তবে এসব করে দুটি বাড়ি করা অসম্ভব। সব শেষ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় তাকে প্রচারণায় দেখেছি। ওই সময় লোকমুখে আমি যতটুকু শুনেছি, সালাম ঢাকাতে বেশ কিছু অর্থ প্রতারণায় জড়িয়ে নাকি এলাকায় ফিরেছেন।’

তার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশে বিভিন্ন থানায় চুরি, প্রতারণা, ছিনতাই ও জাল টাকার কারবারের কয়েকটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।২০০৬ সালের ২৭ নভেম্বর বামনা থানায় চুরির মামলা ছাড়াও ঢাকার রামপুরা থানায় জাল নোটের কারবারের অভিযোগে মামলা হয় ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর। ঢাকার সূত্রাপুর থানায় চুরির অভিযোগে মামলা হয় ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর।

ছিনতাই, নারী কেলেঙ্কারিসহ সম্প্রতি বামনায় ইউনিয়ন পরিষদ নিবার্চন কেন্দ্র করে সহিংসতার অভিযোগেও একাধিক মামলা রয়েছে।২০০৬ সালের দিকে বামনা উপজেলার তার নিজ বাড়ির পাশের একটি বাজারের এক ব্যবসায়ীর দোকানে চুরির অভিযোগে এলাকা ছাড়েন সালাম। এই ঘটনায় ওই ব্যবসায়ী মামলা করলে কিছুদিন জেল খেটে জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকা ছাড়েন তিনি।

বাড়ি ছাড়ার পরে ঢাকার মহাখালীতে একটি আবাসিক হোটেলে বয়ের চাকরি জুটে যায় তার। এরপর একটি পত্রিকার বিজ্ঞাপন প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় দিতে থাকেন।

একপর্যায়ে নিজেকে সাংবাদিক হিসেবেও পরিচয় দিতে শুরু করেন। মুক্তখবর নামে সংবাদপত্রের পরিচয়পত্রও জোগাড় করেন।

২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ডিবি অফিসার সেজে প্রতারণার চেষ্টাকালে ধরা পড়েন সালাম। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা হয় এবং তিনমাস বন্দি থেকে জামিন পান।

ব্যবসায়ীদের যে অভিযোগ

ছিনতাই, গাড়ির যন্ত্রাংশ বিক্রেতা, ডলারের কারবারি আরও নানা পেশার পরিচয় দিয়ে বেড়ান তিনি। সচিব, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আবার গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকতার্দের সঙ্গে সখ্যতার গল্প বানিয়েও মানুষ ঠকানোর অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি ঢাকার নবাবপুরের মেসার্স অথি অ্যান্ড বিনতি এন্টারপ্রাইজ নামে একটি দোকানের মালিক ঝুমুর কর্মকারের কাছ থেকে তিনি ১৫ লাখ টাকা মেরে দিয়েছেন বলে ওই ব্যবসায়ী ঢাকার ওয়ারী থানা ও বরগুনা পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন।

একই এলাকার গাড়ি যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ী তানভির হোসেনের কাছ থেকে ২৬ লাখ টাকা, ঢাকার মুগদার আসবাবপত্র ব্যবসায়ী সাজেদুল হক ১৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনেছেন সালামের বিরুদ্ধে।

নবাবপুরের যন্ত্রাংশ ব্যবসায়ী ঝুমুর কর্মকার জানান, সালাম প্রায়ই তার দোকানে যন্ত্রাংশ বিক্রি করতেন। অল্পদিনেই সখ্য তৈরি হয়। তার কাছ থেকে প্রায়ই দুই এক লাখ টাকার যন্ত্রাংশ কিনতেন।

‘এক পর্যায়ে তিনি আমাকে কমদামে বিভিন্ন প্রকার পার্টস বিক্রি করবেন বলে প্রলোভন দেখান। আমি প্রলোভনে ভুলে যাই। ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ আমি তার কাছ থেকে পার্টস কেনার জন্য ১৫ লাখ টাকা দেই। টাকা দেয়ার সময় তিনশ টাকার স্ট্যাম্পে চুক্তি করি।

‘টাকা গ্রহণের পর থেকে তিনি লাপাত্তা। তার গ্রামের বাড়িতে গিয়েও পাইনি। থানায় মামলা করেছি। তবুও প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আমি বর্তমানে অসহায়ভাবে দিন কাটাচ্ছি’- বলেন ওই ব্যবসায়ী।

গত ২৩ মার্চ বরগুনা পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করেন ঝুমুর কর্মকার। ওই দিনই বামনা থানার ওসি হাবিবুর রহমানকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য লিখে দেন পুলিশ সুপার। পুলিশ তাকে খুঁজতে বাড়িতে গেলে ২৬ মার্চ তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়।ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘টাকা নেয়ার ঘণ্টাখানেক পর ফোন বন্ধ থাকায় আমার সন্দেহ হয়। বেশ কিছুদিন তার নম্বর বন্ধ পেয়ে নিশ্চিত হই সালাম প্রতারক। পরে তার জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর অনুসন্ধান করে ১৩টি নম্বর বের করি এবং প্রতিদিনই চেষ্টা করি যোগাযোগের।

‘আগস্ট মাসের শেষের দিকে হঠাৎ একদিন তার একটি নম্বর খোলা পেয়ে ওয়ারী থানায় যোগাযোগ করি। পুলিশের সহায়তায় জানতে পারি, সালাম মুগদা হাসপাতাল এলাকায় অবস্থান করছেন। ১৭ সেপ্টেম্বর আমি লোকজন নিয়ে গিয়ে মুগদা মেডিক্যালের সামনে থেকে তাকে আটক করি।

‘এ সময় সে সাংবাদিক পরিচয় দেয়, পুলিশ দেখে চিৎকার করে। পরে পুলিশের সাব ইনস্পেক্টর পলাশ সরকার তাকেসহ আমাদের মুগদা থানায় নিয়ে যায়। থানায় গিয়ে সে টাকার বিষয়টি স্বীকার করে এবং সময় নিয়ে মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পায়।’

ওই মুচলেকায় সালাম ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করেন। তিনি ঠিকানা দেন বগুড়া সদর।

সালাম ঢাকায় ৫৬/৩ উত্তর মুগদাপাড়ার বাসায় থাকতেন। মুচলেকায় দেয়া নির্দিষ্ট তারিখে টাকা না দিয়ে তিনি আবার ফোন বন্ধ করে রাখেন। পরে মুগদা থেকে ডেমরার কাজলার পাড় এলাকায় পরিবারসহ চলে যান।

আমি সেখান তাকে খুঁজতে গেলে ২০১৯ সালের অক্টোবরে বামনায় চলে আসেন সালাম।

ঢাকার আরেক ব্যবসায়ী নিউ এসবি মেশিনারিজের মালিক তানভির হোসেন বলেন, ‘সালাম আমাকে জানায়, তিনি চায়নায় পার্টসের ব্যবসা করেন। মাঝে মাঝে আমিও তার কাছ থেকে অনেক পার্টস কিনেছি।

‘যেহেতু আমাকে দেশের বাহির থেকে অনেক পার্টস কিনতে হয়, সেজন্য ডলারের প্রয়োজন হয় খুব বেশি। কিছুটা কম খরচায় ডলার কেনার জন্য তিনি আমাকে উৎসাহ জোগান। আমিও রাজি হয়ে যাই। ডলার কিনতে প্রায় ২৬ লাখ টাকা দেই তাকে। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি তিনি প্রতারণা করবেন। আমার সব টাকা নিয়ে তিনি এখন লাপাত্তা। আমি এখন নিঃস্ব।’

ঢাকার মুগদা বিশ্বরোড এলাকায় চায়না ফার্নিচারের মালিক সাজেদুল ইসলামের কাছ থেকেও একই প্রক্রিয়ায় ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সাজেদুল জানান, ওয়ারড্রোব ও খাট কেনার সূত্র ধরে পরিচয় হয় সালামের সঙ্গে। তিনি চীন থেকে কেমিক্যাল বোর্ড সরবরাহ করবেন বলে টাকা দেন। কিন্তু লাপাত্তা হয়ে যান।

প্রতারণার জালে প্রবাসীও

বামনা সদর ইউনিয়নে নিজামতলী গ্রামের অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী জাকারিয়া হোসেন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকেও দেড় লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ মিলেছে।

জাকারিয়া নিউজবাংলাকে জানান, ফেসবুকে সালামের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। তিনি পাসপোর্ট সংক্রান্ত যে কোনো কাজ করতে পারবেন জানানোর পর একটি পাসপোর্ট রিনিউ করতে দেড় লাখ টাকা দেন। কিন্তু টাকা নেয়ার পর সালাম উধাও, পাসপোর্টটিও ফেরত দেয়নি। পাসপোর্ট না থাকায় তিনি অভিবাসন নিয়ে জটিলতায় ভুগছেন বলে জানান।

সালামের খোঁজ পাওয়া কঠিন

বামনার আমতলী গ্রামে একটি বাড়িতে গিয়ে সালামের বড় স্ত্রী ও তার সন্তানকে পাওয়া যায়।

সেই নারী নিজের নাম বলতেও রাজি হননি। সালামের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলেও কিছু জানেন না বলে দাবি করেন।

পরে নানাভাবে সালামের মোবাইল ফোন নম্বর জোগাড় করে বুধবার দুপুরে মুঠোফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় আবাসিক হোটেলে চাকরি করতাম, এখন মুক্তখবর নামের একটি দৈনিকে বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করি।’

ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘তারা ইয়াবা কারবারে জড়িত, তাদের ধরিয়ে দেয়ায় আমার বিরুদ্ধে এসব বলে বেড়াচ্ছে।’

বাড়ি করার টাকা কোথায় পেয়েছেন-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পৈতৃক কিছু জমি বিক্রি, ডিপিএস ও শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা জোগাড় করে বাড়ি করেছি।’

ঢাকার একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যতার দাবিও করেন সালাম। বরগুনার পুলিশ সুপার ও বামনা থানার ওসির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলেও দাবি তার।

পুলিশ যা বলছে

বামনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বামনা থানায় সালামের বিরুদ্ধে একটি চুরির মামলা রয়েছে। ওই মামলায় জেল খেটেছেন তিনি। ঝুমুর অভিযোগ করার পর আমরা তার বাড়িতে খোঁজ নিই। তিনি বর্তমানে এলাকায় নেই।’

বরগুনার পুলিশ সুপার মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন মল্লিক বলেন, ‘সালামের বিরুদ্ধে ঢাকার এক ব্যবসায়ী প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করেছেন। আমি বিষয়টি দেখতে বামনা থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছি।’

এ বিভাগের আরো খবর