নারায়ণগঞ্জে প্রায়ই ঘটছে বিস্ফোরণের ঘটনা। এতে হতাহতও হচ্ছে মানুষ। বেশির ভাগ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে দাহ্য গ্যাস।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গ্যাসের পাইপে লিকেজ হলে ঘরের আনাচকানাচে বিভিন্ন জায়গায় গ্যাস জমা হয়। আগুন বা বিদ্যুৎ স্পার্ক করলে এই গ্যাস বোমার মতো বিস্ফোরিত হয়। গ্যাস বিস্ফোরণের আগুনে দগ্ধ হতে সময় লাগে ১৫ সেকেন্ড।
গ্যাস থেকে বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা করেছে ফায়ার সার্ভিস। তবে পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় যাদের মৃত্যু হয়, তারা থেকে গেছে তালিকার বাইরে।
গত ৩১ ডিসেম্বর ফায়ার সার্ভিস প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে গ্যাস থেকে বিস্ফোরণে ১০৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮৬টি ঘটেছে পাইপলাইনের গ্যাস থেকে।
এতে দগ্ধ ৮২ জনের মধ্যে প্রাণহানি হয়েছে ৩৯ জনের। শুধু একটি ঘটনাতেই মৃত্যু হয় ৩৭ জনের।
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন নিউজবাংলাকে জানান, এ বছরও এ ধরনের ঘটনা কম হয়নি।
এ বছর এখন পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে ছয়টি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। দগ্ধ ২৭ জনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৯ জনের।
উপসহকারী পরিচালক আব্দুল্লাহ আল আরেফীন জানান, প্রতিবছর ডিসেম্বরে প্রতিবেদন তৈরি করে তিতাস, জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠানো হয়। এ বছর থেকে ছয় মাস পর পর প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।
তবে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির নারায়ণগঞ্জের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার গোলাম ফারুক জানান, এ তালিকার বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
তার দাবি, গ্যাসের লাইন মেরামত করার জন্য তিতাসের টিম ২৪ ঘণ্টা কাজ করে। যেখানেই লিকেজের তথ্য পাওয়া যায়, সেখানেই দ্রুত গিয়ে লাইন ঠিক করা হয়। সংস্কার করা হয় পুরোনো পাইপ।
৯ মার্চ ফতুল্লার মাসদাইরের পতেঙ্গা এলাকায় ছয়তলা ভবনের ষষ্ঠ তলায় ঘরে জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ হয়।তিনি আরও জানান, যদি কোনো বাড়িতে অবৈধ গ্যাস-সংযোগ থাকে, তাহলে লিকেজের কথা তিতাসকে জানানো হয় না। এ ক্ষেত্রে বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়ে।
জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানান, অবৈধ সংযোগ নিলে বা গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রিতে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি মনিটর করা হয়। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
তিনি বলেন, ‘রান্নার কাজে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। রান্নার পর চুলা বন্ধ করতে হবে। যদি গ্যাসের পাইপে লিকেজ, সিলিন্ডার বোতলে লিকেজ বা এ-সংক্রান্ত অন্য কোনো সমস্যা থাকে তাহলে তা দ্রুত তিতাস কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনকে জানাতে হবে।’
কেউ জানাতে দেরি করলে তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।
নিয়ম অনুযায়ী বাতাস চলাচলের খোলা জায়গায় গ্যাস সিলিন্ডার রাখতে হবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র আলাদা।
১ জানুয়ারি আড়াইহাজারে একটি রেস্তোরাঁয় গ্যাসের লাইন বিস্ফোরণে একজনের মৃত্যু হয়।শহরের বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, ঘরের ভেতরের কোনায় রাখা হয়েছে গ্যাস সিলিন্ডার। কোথাও বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে সিলিন্ডার।
মুরগির দোকান, প্লাস্টিক পণ্য ও হার্ডওয়্যারের দোকান, মুদি দোকান, ওষুধের দোকানেও বিক্রি হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। অনেকেরই নেই গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির অনুমোদন।
তেল, গ্যাস, খনিজসম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটির নারায়ণগঞ্জের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ‘পাইপলাইনে ঠিকমতো গ্যাস না পাওয়ায় অনেকেই সিলিন্ডার ব্যবহার করেন। কিন্তু ব্যবহারের নিয়ম না জানায় দুর্ঘটনা ঘটে।’
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিস্ফোরণে নিহত হওয়ার ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না।
চলতি বছরে নারায়ণগঞ্জে গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ
গত শুক্রবার ফতুল্লার তল্লার জামাই বাজার এলাকায় তিনতলা ভবনের তৃতীয় তলায় ঘরে জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণ হয়। এতে দগ্ধ হন পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকা দুই পরিবারের ১১ সদস্য। তাদের মধ্যে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুইজনের মৃত্যু হয়েছে।
এর আগে ১২ এপ্রিল রাতে শহরের আমলাপাড়ার প্রেসিডেন্ট রোড এলাকায় গ্রিন জিএম গার্ডেন নামের একটি ভবনের আটতলায় গ্যাস বিস্ফোরণে আগুনে দগ্ধ হয়েছেন দুইজন। তাদের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নৈশপ্রহরীর মৃত্যু হয়।
৯ মার্চ ফতুল্লার মাসদাইরের পতেঙ্গা এলাকায় ছয়তলা ভবনের ষষ্ঠ তলায় গ্যাসপাইপের লিকেজ থেকে ফ্ল্যাটে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে একই পরিবারের শিশুসহ দগ্ধ ছয়জনের মধ্যে চিকিৎসাধীন অবস্থায় চারজনের মৃত্যু হয়।
তার আগে ৭ জানুয়ারি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের বিলাসনগর এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে রফিক উল্লাহ নামে এক মিস্ত্রির মৃত্যু হয়।
বছরের একদম প্রথম দিন আড়াইহাজারে একটি রেস্তোরাঁয় গ্যাসের লাইনে বিস্ফোরণে তিনজন অগ্নিদগ্ধ হন। হাসপাতালে তাদের একজনের মৃত্যু হয়।