হালদাপারের ডিম সংগ্রহকারীদের ব্যস্ততার সীমা নেই, ডিম আহরণের জন্য চলছে নানান কর্মযজ্ঞ। কেউ নতুন নৌকা তৈরি করছেন, আবার কেউ নৌকা মেরামতে ব্যস্ত, কেউ কেউ মাটির কুয়া তৈরি করছেন ডিম থেকে রেণু তৈরির জন্য।
প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুন মাস বজ্রসহ ভারী বর্ষণের সময় হালদায় ডিম ছাড়ে মা মাছ। এ দুই মাস ডিম ছাড়ার ভর মৌসুমে পাহাড়ি ঢল নামলে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালাবাউশ জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে।
হালদা নদীর পাড়ে হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শার জলদাশ পাড়ার জেলেপল্লিতে ৪২টি পরিবারের বসবাস। এই নদীকে ঘিরেই হরিদাশের জীবনজীবিকা। প্রতিবছর যে ডিম সংগ্রহ করে সেগুলো বিক্রি করে বছরজুড়ে সংসার চালান তিনি।
হরিদাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রতি বছর মধ্য এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে মা-মাছ ডিম ছাড়ে। এ সময়টা আমাদের জন্য অনেক আনন্দের। ডিম সংগ্রহের জন্য আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি চলছে। নতুন নৌকা, পুরাতন নৌকাগুলো ভালোমতো মেরামত করছি। মাছের পোনা সংগ্রহ করার জন্য কুয়া তৈরি করতে এখন ব্যস্ত আমরা।’
জেলা মৎস্য কার্যালয়ের তথ্যমতে, হালদার দুই পাড়ের রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার প্রায় ৬০০ জন ডিম সংগ্রহকারী রয়েছেন, যারা প্রতি মৌসুমে হালদা থেকে ডিম সংগ্রহ করেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী বলেন, ‘ডিম ছাড়ার সময় হওয়ায় নদীতে মা-মাছের আনাগোনা বাড়ে। এ সময় কার্প জাতীয় মাছের নিষিক্ত ডিম আহরণ করেন ডিম আহরণকারীরা। এরপর সেই ডিম কুয়াতে রেণু করা হয়। তারপর রেণু থেকে তৈরি হয় পোনা।’
এ বছর বেশি ডিম সংগ্রহ হওয়ার আশা করছেন জেলে ও বিশেষজ্ঞরা।
তারা জানান, করোনাভাইরাসের কারণে শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকায় নদীর দূষণ কমেছে। তাই চলতি বছর হালদা থেকে রেকর্ড পরিমাণ ডিম সংগ্রহের আশা করছেন তারা।
হালদা নদী দেশে স্বাদু পানির কার্পজাতীয় মাছের প্রধান প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে হালদা নদী চট্টগ্রামের রাউজান ও হাটহাজারী উপজেলার প্রায় ৯৮ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে প্রবাহিত হয়ে মিশেছে কর্ণফুলী নদীতে।
সাধারণত চৈত্র থেকে আষাঢ়ের মধ্যে হালদায় পাহাড়ি ঢল নামে। এ সময়ে পূর্ণিমা-অমাবস্যার তিথিতে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা অনুকূলে থাকলে ডিম ছাড়ে রুই, কাতলা, মৃগেলসহ বিভিন্ন কার্পজাতীয় মাছ। সাধারণত এসব মাছ মধ্য এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে হালদায় ডিম ছাড়ে। তবে মে মাসেই বেশির ভাগ ডিম সংগ্রহ করা হয়।
তবে বিগত কয়েক বছরে শিল্প-কারখানার দূষণসহ নানা কারণে হালদার বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে মাছের প্রজননে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা গবেষক ড. মঞ্জুরুল কিবরীয়া বলেন, হালদা নদীতে ডিম ছাড়ার জন্য মার্চ থেকে মাছ নদীতে অবস্থান করছে। আশা করি, এবার মাছ রেকর্ড পরিমাণ ডিম ছাড়বে।
এদিকে মা মাছ শিকার বন্ধে হালদায় অভিযান অব্যাহত রেখেছে প্রশাসন।
হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রহুল আমিন বলেন, ‘প্রজনন মৌসুম সামনে রেখে মা-মাছ শিকারিরা তৎপর। তাই আমরা কঠোর অবস্থানে রয়েছি। প্রতিদিন আমাদের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সারা বছর নদী থেকে মাছ শিকার নিষিদ্ধ থাকা, নিয়মিত অভিযানে অবৈধ জাল জব্দ, বালু উত্তোলন বন্ধ, ড্রেজার পরিচালনা ও ইঞ্জিন চালিত নৌকা বন্ধ থাকায় মা-মাছের নিরাপদ বিচরণ অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে।’
হালদা নদী থেকে ২০১৮ সালে ২২ হাজার কেজি এবং ২০১৯ সালে ১০ হাজার কেজি ডিম আহরণ করা হয়। আর ২০২০ সালে ২৫ হাজার কেজি ডিম সংগ্রহ করে রেকর্ড করেছে ডিম আহরণকারীরা।