বিদ্যুৎ বিভাগের করা ‘বিল খেলাপির’ এক মামলায় চার দিন কারাভোগ করেছেন এক গ্রাহক। জামিন পেতে নানা হয়রানির শিকার হয়েছে তার পরিবার। হয়েছে আর্থিক ক্ষতি। কিন্তু মামলাটির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না ওই গ্রাহকের। একই নামের আরেক গ্রাহকের মামলায় তাকে সাজা খাটতে হয়েছে।
পুরো ঘটনাতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন গাইবান্ধা নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি দায় এড়াতে ব্যস্ত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তাদের ভুলেই ঘটেছে এ বিপত্তি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিনা দোষে কারাভোগ করা ব্যক্তি একজন ডেকোরেটর ব্যবসায়ী। তার নাম মো. আব্দুল রাজ্জাক মিয়া। বয়স ৪২ বছর। বাবার নাম সমেস উদ্দিন। বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার রাধাকৃষ্ণপুর গ্রামে। তিনি বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন গাইবান্ধা নর্দার্ন ইলেক্ট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো-১) গ্রাহক। অথচ নেসকো-২-এর দায়িত্বে থাকা নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদুল হক মামলা দিয়ে তাকে কারাভোগ করিয়েছেন।
বিদ্যুৎ বিভাগের (নেসকো-২) করা বিল খেলাপি মামলার প্রকৃত আসামি ৮৪ বছরের বৃদ্ধ একই গ্রামের আব্দুল রাজ্জাক। তার বাবার নাম কিয়ামত উল্লা। তিনি নেসকো-২-এর গ্রাহক এবং নথিতে বিল খেলাপি ছিলেন। খেলাপি বিলের পরিমাণ ৬৫ হাজার ১৩৮ টাকা। এটা সেচপাম্প চালানোর বিল।
ভুক্তভোগী আব্দুল রাজ্জাক মিয়া নিউজবাংলাকে জানান, কয়েক বছর আগে তার নামে থাকা একটি সেচপাম্প তিনি বিক্রি করেন চাচাতো ভাই শফিকুল মিয়ার কাছে। বিক্রির আগে সেই পাম্প চালানোর সব বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছেন তিনি। এরপর থেকে শফিকুল মিয়া সেচপাম্পটি পরিচালনাসহ নিয়মিত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে আসছেন। সেখানে বিল খেলাপের কোনো অভিযোগ নেই।
কিন্তু ‘বিল খেলাপির’ দায়ে করা বিদ্যুৎ বিভাগের এক মামলায় গত ১৪ মার্চ গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর নানা তথ্যপ্রমাণ হাজির করলেও গাইবান্ধা সদর থানা পুলিশ রংপুর বিদ্যুুৎ আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। চার দিন কারাভোগ করার পর রংপুরের বিদ্যুৎ আদালতের মাধ্যমে জামিন মেলে। জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও সেচপাম্পের সব বিদ্যুৎ বিলের কপি নিয়ে থানা ও বিদ্যুৎ অফিসে গেলেও পরিবারের লোকজন মুক্ত করতে পারেননি রাজ্জাককে।
আব্দুল রাজ্জাক মিয়া বলেন, ‘আমার পিতার নাম সমেস উদ্দিন। আমি নেসকো-১-এর গ্রাহক। আর অভিযুক্ত আব্দুল রাজ্জাক এক গ্রামের হলেও তার পিতার নাম কিয়ামত উল্লা। তিনি নেসকো-২-এর গ্রাহক। তার মামলাটায় কীভাবে আমাকে জড়াইয়া চার দিন জেল খাটালো, বুঝলাম না। এর জন্যে অনেক হয়রানি হইছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ ধরার আগে বিদ্যুৎ অফিসে তিন-চার দিন গেছি। ওরা বলেছিল কোনো সমস্যা নাই। যেহেতু নাম ভুল হয়েছে, সংশোধন করে দেবে।’
আক্ষেপ করে রাজ্জাক বলেন, ‘আমি নিরীহ মানুষ, কার কাছে বিচার চাই। ক্ষতিপূরণ চাইবার রাস্তা তো জানি না।’
বিদ্যুৎ বিভাগের বিল বকেয়ার দায়ে ৮৪ বছর বয়সী আব্দুল রাজ্জাকের বিরুদ্ধে মামলার পর আদালত তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করলে সেখানে তার পিতার নাম কিয়ামত উল্লার পরিবর্তে লেখা হয় সমেস উদ্দিন। আর এই ভুলে কারাভোগ করতে হয়েছে ডেকোরেটর ব্যবসায়ী আব্দুল রাজ্জাক মিয়াকে।
কথা হয় একই গ্রামের হায়দার আলী, মিন্টু মিয়া, জাহানারা বেগম ও হান্নান মিয়ার সাথে। তারা অভিযোগ করে বলেন, দুই রাজ্জাকের বয়সের পার্থক্য ছাড়াও বাবার নামে মিল নেই। কিন্তু তারপরও নির্দোষ আব্দুল রাজ্জাক মিয়াকে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। যদিও তাৎক্ষণিক নামের বিষয়টি ভুল স্বীকার করে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সংশোধনের আশ্বাস দেন। এরপর ভুলের ঘটনাটি আদালতকে অবগত করলে বৃদ্ধ আব্দুল রাজ্জাককে চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল হাজিরের নির্দেশ দিয়ে সমন দেয় আদালত। এরই মাঝে নির্দোষ আব্দুল রাজ্জাক মিয়াকে করতে হয় কারাভোগ।
কারাভোগ করা আব্দুল রাজ্জাক মিয়ার চাচি আছমা বেওয়া বলেন, 'হামার (আমার) ভাস্তে (ভাতিজা) বিনি অন্যায়তে (নিরাপরাধ) কিসক (কেন) জেল খাটল। হামাগরে (আমাদের) কিসক চোখের পানি বাড়াল। ভাস্তেক একলাই (একা) পাচেন জন্যে জেলত (কারাগার) নিয়ে গেছেন। মগের মুল্লুক নাকি? হামরা হের সুস্তু (সুষ্ঠু) বিচার চাই।’
এদিকে এই ঘটনার দায় নিতে রাজি নয় বৃদ্ধ আব্দুল রাজ্জাকের পরিবার। তার স্ত্রী বাসমনি বেওয়া নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের নামে মামলা-টামলা আর কিচু নাই। আছিল তাক আমরা পরিশোধ করি, আমরা মুক্তি হয়া আছি। আর কোনো কৈফিয়ত আমাদের কাছে নাই। যার কাছে পাম্প বেচ্চি এখন তার কাছে সব।’
গাইবান্ধা সদর উপজেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও আইনজীবী মুরাদুজ্জামান মুরাদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ অফিসের এমন মামলা অযৌক্তিক। এ কারণে বিনা দোষে চার দিন কারাভোগ করেছেন আব্দুল রাজ্জাক মিয়া। এতে তিনি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এটি বিদ্যুৎ অফিসের গাফিলতির একটি বড় দৃষ্টান্ত। আমি মনে করি, এটার সঠিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সেই সাথে দেশের সংবিধান অনুযায়ী বিনা দোষে কারাভোগ করা ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবি রাখেন।’
ঘটনার ব্যাপারে বিদ্যুৎ অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলীর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি ভুলের কথা স্বীকার করলেও দায় এড়াতে চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘বক্তব্য নিতে গেলে ভিকটিমকে নিয়ে আসেন। এটা তো সলভ ইস্যু (সমাধান হয়েছে)। এই ভুলের কারণে তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করা হয়েছে। আমরা কেউ লোকাল না। এটা সোর্সের ভুলে হয়েছে। শুধু ভুল হয়েছে বাবার নামে। ইনফরমার ভুল তথ্য দিলে আমার কী করার আছে।’
নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, ‘এটা জাস্ট মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং। এ কারণে তাকে অফিস থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হয়েছে। আরও যদি কোনো ইস্যু থাকে তা হলে প্যানডামিকের পরে আসেন। সমাধান করে দেব।’