বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দূষণে ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে: গবেষণা

  •    
  • ২১ এপ্রিল, ২০২১ ২২:৫১

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেশি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দূষণের মাত্রা আরও বাড়াবে। বায়ুর দূষণ শুধু মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, এতে জীববৈচিত্র্যও নষ্ট হবে। সাগরের মাছ মরে যাবে। দূষণের কারণে কক্সবাজারের পর্যটক কমে যাবে।

চট্টগ্রামে অঞ্চলে নির্মিত হতে যাওয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দূষণে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ বায়ুবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে বলে এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যৌথ উদ্যোগে ‘বায়ুর মান, স্বাস্থ্য পরিবেশের ওপর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ক্ষতিকর প্রভাব’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।

এই গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রস্তাবিত কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যে পরিমাণ বায়ুদূষণকারী পদার্থের উৎপাদন করবে সেগুলো বছরে কমপক্ষে ৬৫০ জনের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে। স্ট্রোক, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, শ্বাসযন্ত্রজনিত জটিলতায় এসব মৃত্যু ঘটবে।

কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ৩০ বছরে যে বিষাক্ত পদার্থ বাতাসে নিঃসরণ করবে, তা অন্তত ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যুর কারণ হবে। এর মধ্যে চার হাজার ১০০ জন মারা যাবে ফুসফুসের রোগে ভুগে। সাত হাজার ৭০০ জন হৃদরোগে, তিন হাজার ১০০ জনের মৃত্যু হবে শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে, এক হাজার ৩০০ জনের মৃত্যু হবে ফুসফুসের ক্যান্সারে এবং ছয় হাজার ৪০০ জন মারা যাবে স্ট্রোকে। নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইডের বিষক্রিয়ায় মারা যাবে পাঁচ হাজার ৯০০ জন।

গবেষণায় আরো বলা হয়, প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বাতাসে ৬ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ এবং ১ হাজার ৬০০ কেজি পারদ নিঃসরণ করবে। ফ্লাই অ্যাশের মধ্যে থাকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ও তেজস্ক্রিয় ধাতু। এর মধ্যে বাতাসে ছড়িয়ে পড়া পারদের মধ্যে ৪০ শতাংশ মাটি ও স্বাদুপানির জলাশয়ে জমা হবে, এতে খাদ্যে পারদের পরিমাণ বাড়বে। কেন্দ্রগুলো থেকে নিঃসৃত ধাতু চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভূমি ও মিঠাপানির বাস্তুতন্ত্রকে দূষিত করবে।

গবেষণায় বলা হয়, উপকূলীয় এলাকা চট্টগ্রামে প্রায় ১ লাখ মৎস্যজীবী রয়েছে। চট্টগ্রামের কক্সবাজারে বছরে ৩০০ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদন হয়। অথচ প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে বছরে ৬৯০ কেজি পারদ জমা হবে। এই পারদ সরাসরি পানিতে গিয়ে মিশবে। তখন জলের বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মাছের উৎপাদন কমে যাবে। এতে করে বাংলাদেশের শুঁটকি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিশ্বের কোথাও এতগুলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র একসঙ্গে এত কাছাকাছি এলাকার মধ্যে নির্মিত হয়নি উল্লেখ করে গবেষণার সারাংশে বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বের দূষিত বায়ুর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। বায়ুদূষণ এখানে মানুষের গড় আয়ু প্রায় ২ বছর কমিয়ে দেয়।

বায়ুদূষণ বিবেচনায় ঢাকার অবস্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির পরেই এর অবস্থান। ঢাকার বাতাসে বায়ুদূষণকারী সুক্ষ্ম কণা পিএম ২.৫ এর গড় মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত মাত্রার ৮ গুণ এবং জাতীয় বায়ু মানের ৬ গুণ। এই পরিস্থিতি আরও শোচনীয় করে তুলবে চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রস্তাবিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো।

এটা হবে পৃথিবীর বৃহত্তম কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ হাবের একটি যেখানে দূষণকারী পদার্থের নিঃসরণের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকবে খুবই শিথিল। ১৪টি বয়লার সম্বলিত প্রায় ৯ গিগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চট্টগ্রাম অঞ্চলের কক্সবাজার ও মিরসরাইকে দূষণের হটস্পট পরিণত করবে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। বিষাক্ত বায়ু নিয়ন্ত্রণে এসব কেন্দ্রের ক্ষমতা থাকবে কম। ইউরোপে থাকা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিষাক্ত পদার্থ নির্গমণ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতার চেয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা ২৫ গুণ কম। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হবে।

গবেষণাটির ব্যবস্থাপনায় ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। গবেষণার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, “বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কয়লার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানতে পারছে এবং দূষণের কারণে অকালমৃত্যুর পাশাপাশি বিকলাঙ্গের মতো মারাত্মক ক্ষতির জন্য কয়লাকে দায়ী করছে। সারা পৃথিবী যখন কয়লার অভিশাপ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করছে, তখন বাংলাদেশে নতুন নতুন কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন শুধু জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সিদ্ধান্ত নয়, বরং এটি একটি দুরভিসন্ধিমূলক ষড়যন্ত্রের অংশ।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনিতে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেশি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দূষণের মাত্রা আরও বাড়াবে। বায়ুর দূষণ শুধু মানুষের জন্য ক্ষতিকর নয়, এতে জীববৈচিত্রও নষ্ট হবে। সাগরের মাছ মরে যাবে। দূষণের কারণে কক্সবাজারের পর্যটক কমে যাবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া নিউজবাংলাকে বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলে। এসব কেন্দ্র থেকে যেসব বিষাক্ত পদার্থ বের হবে সেগুলো জলে থাকা প্রাণীর শরীরের মধ্যে মিশে যাবে। আমাদের রপ্তানি আয়ের অন্যতম খাত হচ্ছে মৎস্য খাত। বিশেষ করে সামুদ্রিক মৎস্য প্রচুর রপ্তানি হয় এ দেশ থেকে। কেন্দ্রগুলোর বিষাক্ত পদার্থ যদি ইলিশ, চিংড়িসহ রপ্তানিযোগ্য মৎস্য প্রজাতির শরীরে পাওয়া যায় তাহলে সেগুলো আর বিদেশে রপ্তানি করা যাবে না। তখন মৎস্যখাত হুমকির মুখে পড়বে।

উপকূলীয় এলাকায় জলবায়ু নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আবদুর রহমান রানা। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে নিজেদের দাবি করছে। ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম নিয়ে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু বাংলাদেশ নিজেই জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ক্ষতিকর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলছে। এতে করে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ দাবি করার যে অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে সেই অধিকার আর থাকবে না।

এখন কয়লার অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ বাংলাদেশের রয়েছে। সরকার সকল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ বন্ধও করবে বলে আশা প্রকাশ করেন পরিবেশবিদ শরীফ জামিল।

এ বিভাগের আরো খবর