চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ তলার ২৪ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ড। ভেতরে ঢুকে একটু এগোলে হাতের ডান পাশের একটি শয্যায় শুয়ে আছেন আমির বিন আকাশ নামের এক তরুণ।
তার শয্যার বাম পাশে ঝোলানো রক্তের ব্যাগ। এক ফোঁটা-দুই ফোঁটা করে তার শরীরে প্রবেশ করছে সেই রক্ত। আর ডান পাশে ঝোলানো স্যালাইনের ব্যাগ। একটু নড়াচড়া করতে গেলেই ব্যথায় গোঙাতে থাকেন ১৮ বছরের এই তরুণ শ্রমিক।
পাশে বসে থাকা তার মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। শনিবার সকালে বাঁশখালীর গন্ডামারায় নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রে শ্রমিক বিক্ষোভের সময় পুলিশের গুলিতে আহত হন আমর। তলপেটের একটু নিচে বাম দিকে গুলি ঢুকে বের হয়ে গেছে।
আমরের মা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা শুনে আমি আর ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ি। দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। আমি সোমবার ছাড়া পেয়েছি। কিন্তু ওর বাবা এখনও অসুস্থ। আমার ছেলেটার এই বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা। নিজের খরচ নিজে জোগাতে ৬ মাস আগে চাকরি নেয় ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রে।
‘কিন্তু শনিবার সকালে সব উল্টাপাল্টা হয়ে গেল। জানি না, এখানে এভাবে কত দিন থাকতে হবে। ওরা শুধু ব্লাড দিয়েই যাচ্ছে। সরকারি মেডিক্যাল হওয়ায় চিকিৎসাটা এখানে ঠিকমতো হচ্ছে। কিন্তু ওষুধ ও অন্যান্য খরচ মেটাতে হচ্ছে নিজেদেরই। এখন পর্যন্ত আমাদের ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে গেছে।’
বাঁশখালীর গন্ডামারা ইউনিয়নের পশ্চিম বড়ঘোনায় এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শনিবার বেলা ১১টার দিকে বেতন-ভাতাসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভে নামেন শ্রমিকরা। এ সময় পুলিশ গুলি করলে ৫ জন নিহত হন। আহত হন কমপক্ষে ২০ জন।
আমর আহত ব্যক্তিদেরই একজন। তার পরের শয্যায় চিকিৎসাধীন ৪২ বছর বয়সী সৈয়দ আহম্মেদ। তিনিও একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ। ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। তার স্ত্রী বাসায় অসুস্থ। বড় কোনো ছেলেমেয়েও নেই। তাই হাসপাতালে তার দেখভাল করছেন শ্যালক কাউছার হোসাইন।
কাউছার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শুনেছি, কেউ কেউ নাকি ৫০ হাজার টাকা করে পেয়েছেন। কিন্তু আমার ভগ্নিপতি কিছু পাননি। সব ধরনের ওষুধ আমাদের নিজেদের কিনতে হয়৷ পরীক্ষাগুলোও নিজের টাকায় করতে হয়। এখন পর্যন্ত আমাদের ২০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়েছে। তবে শুনেছি, এস আলম ও সেপকো কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার খরচ দেবে আমাদের। কিন্তু সেটা কখন? একে তো কোনো কথাবার্তা ছাড়া গুলি চালাল, তার ওপর এই চিকিৎসার কষ্ট!’
সৈয়দ আহম্মেদের কয়েকটি শয্যা পরে চিকিৎসাধীন সিলেটের আমিনুল হক। তার বড় ভাই মুমিনুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পরদিন বিদ্যুৎকেন্দ্র কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে এসে ৫০ হাজার টাকা দেয়। আপাতত সব খরচ চলছে সেই টাকা দিয়েই৷ কিন্তু সেই টাকায় চিকিৎসা শেষ হবে কিনা কিংবা আর কোনো সহায়তা পাব কিনা জানি না।’
২৪ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ারুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পরপরই ২৪ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ড ৩ জন পুলিশ সদস্যসহ ২১ জনকে আনা হয়েছিল। এরপর পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কয়েকজনকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আর কয়েকজনকে অন্য ওয়ার্ডে রেফার করা হয়েছে। বর্তমানে আমার ওয়ার্ডে মোট ৪ জন চিকিৎসাধীন। তা ছাড়া আরেকজন এখনও আইসিইউতে চিকিৎসাধীন।’
আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ভার কে বহন করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো আমরা জানি না। আমাদের কাজ শুধু চিকিৎসা দেয়া।’
আহত শ্রমিকদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষের বহন করার কথা। কিন্তু তা বহন করছে না কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রধান সমন্বয়ক মোস্তান বিল্লাহ আদিলের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।