হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ইকরতলীতে আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৭৪টি ভূমিহীন পরিবারকে গত ২৩ জানুয়ারি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়। ওই দিনই নিউজবাংলার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, বিভিন্ন সমস্যার কারণে ভূমিহীনরা এই ঘরগুলোতে থাকবেন না। সেই আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর দেয়া উপহারের ঘরে উঠতে অনাগ্রহী হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার আশ্রয়ণ প্রকল্পের মানুষ। তাদের দাবি, যে জায়গায় ঘর দেয়া হয়েছে এর ১০ কিলোমিটারের ভেতরে কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। নেই বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা। ওই স্থানে মাথার গোজার ঠাঁই থাকলেও রয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগ।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, ঘর বরাদ্দে সীমাহীন অনিয়ম করা হয়েছে। স্থানীয়দের ঘর না দিয়ে দেয়া হয়েছে ১৫ কিলোমিটার দূরের কালেঙ্গা বনের বাসিন্দাদের। যাদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তারা বনের ভেতরে জুমসহ বিভিন্ন চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। যে কারণে কর্মসংস্থানের অভাবে ওইসব লোক বন ছেড়ে এই ঘরে উঠছেন না।
এ সব অভিযোগ সম্পর্কে প্রশাসনের জবাব, এই প্রকল্পে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। নিয়ম অনুযায়ী, তাদেরকেই বিদ্যুৎ সংযোগ আনতে হবে। এ ছাড়া যারা এখনও ঘরে ওঠেননি, তাদের বরাদ্দ বাতিল করে নতুনদের বরাদ্দ দেয়া হবে।
গত ২৩ জানুয়ারি সারা দেশের সঙ্গে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ইকরতলি আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু ঘরের চাবি ও কাগজপত্র নেয়ার পর অধিকাংশ পরিবারই আর সেখানে ওঠেননি। কেউ কেউ উঠলেও কিছুদিন থাকার পর আবার চলে গেছেন।
সম্প্রতি ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র ২১টি ঘরে মানুষ বসবাস করছেন। বাকি ৫৩টি ঘরেই তালা ঝুলছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পে বসবাসকারীদের অভিযোগ, সেখানে কাজের কোনো সুযোগ নেই। যাতায়াতের ব্যবস্থাও নাজুক। তিন মাসেও দেয়া হয়নি বিদ্যুৎ সংযোগ। এ ছাড়া ৭৪টি পরিবারের জন্য রয়েছে মাত্র চারটি টিউবওয়েল। এসব সমস্যার কারণে ৫৩টি ঘরের বাসিন্দা তালা ঝুলিয়ে চলে গেছেন তাদের আগের বাসস্থানে।
ইকরতলী আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা আলেয়া বেগম বলেন, ‘এখানে পানির খুব সমস্যা। ৭৪টা পরিবারের জন্য মাত্র চারটা টিউবওয়েল। তবে আমরা এখানে ২১টা পরিবার থাকি। টিউবওয়েলের চারপাশ খোলামেলা। গোসল করতে গেলে আমাদের মহিলাদের সমস্যা হয়। এত মানুষের গোসল, থালা-বাসন ধোয়া, মাছ-সবজি ধোয়া, সবকিছুই টিউবওয়েলে করতে হয়। যে কারণে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘এখানে জমি নেই, রাস্তাঘাট ভালো না, মানুষের যাতায়াত নেই। যে কারণে কাজও নেই। আমার স্বামী অনেক দূরে গিয়ে যা কাজ পায় তাই করে। অনেক কষ্ট করে চলতে হচ্ছে। এভাবে আর বেশিদিন থাকা সম্ভব না। অন্যদের মতো আমাদেরও চলে যেতে হবে।’
নূরুন্নাহার বেগম বলেন, ‘তিন মাস হয়ে গেছে এখানে আসছি। এখনও বিদ্যুৎ পাইনি। গরমে বাচ্চা কান্নাকাটি করে। গতকাল এসি (ভূমি) স্যার আসছিলেন। তিনি বলছেন, দুই হাজার টাকা করে দিলে বিদ্যুৎ দিবেন। আমরা গরিব মানুষ দুই হাজার টাকা কী করে দেব।’
তিনি বলেন, ‘এখানে অনেক পরিবার এসে আবার চলে গেছে। কারণ এখানে অনেক সমস্যা। কাম-কাজ নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই। এভাবে কোনো মানুষ থাকতে পারে?’
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা আগে কালেঙ্গা বনে থাকতাম। সেখানে অনেক কাজ ছিল। বাগানে কাজ করতে পারতাম, জুম চাষ করতাম, লাকড়ি কুড়াতাম। কিন্তু এখানে একটা ঘর পেলেও বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। অনেক পরিবার এখান থেকে চলে গেছে। যে অবস্থা এখন আমাদেরও চলে যেতে হবে। এখানে থেকে লাভ নেই।’
আরেক বাসিন্দা আফিয়া বেগম বলেন, ‘এখানে কাজ-কাম নাই। কারেন্ট নাই, পানির সমস্যা। ঝড়-তুফান এলে মনে হয়, ঘরগুলি উড়ে যাবে। এই রমজানে বিদ্যুৎ ছাড়া কতটা কষ্টে আছি আমরাই জানি।’
স্থানীয় বাসিন্দা লিটন মিয়া বলেন, ‘ঘর বরাদ্দ দেয়ার সময় সঠিক লোককে দেয়া হয়নি। এই এলাকার অনেক ভূমিহীন ঘর পায়নি। অথচ কালেঙ্গা বন থেকে লোকজন ধরে এনে ঘর দেয়া হয়েছে। তারা এই ঘরে ওঠেনি।’
তিনি বলেন, ‘বনের মধ্যে তারা বিভিন্নভাবে জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। এখানে এসে কী করবে? আমরা দেখেছি, অনেকে এসে কিছুদিন থেকে আবার চলে গেছেন।’
চুনারুঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সত্যজিৎ রায় দাশ বলেন, ‘এই প্রকল্পে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য কোনো বরাদ্দ নেই। সবাইকে যে নিয়মে বিদ্যুৎ আনতে হয়, তাদেরকেও সেই নিয়মেই আনতে হবে। আর আমাদের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য কোনো টাকা চাওয়া হয়নি। বাকিটা বলতে পারবেন পল্লী বিদ্যুতের জিএম।
‘যারা ঘর পেয়েছেন কিন্তু এখনও আসেননি তাদেরকে আসার জন্য বলা হচ্ছে। এরপরও যদি তারা না আসে তাদের বরাদ্দ বাতিল করে নতুনদের মধ্যে এই ঘরগুলো বরাদ্দ দেয়া হবে।’
হবিগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এজিএম সামিউন্নবী বলেন, ‘ঘরের ওয়্যারিংয়ের জন্য তাদের একটি প্যাকেজ দেয়া হয়েছে। এই প্যাকেজের মূল্য দুই হাজার টাকা। এটিকেই তারা ঘুষ মনে করছে। তারা চাইলে নিজেরাও ইলেক্ট্রিশিয়ান নিয়ে ওয়্যারিং করাতে পারেন। এতে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।’