হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর সহিংসতায় আশঙ্কায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। শহরজুড়ে তৎপর রয়েছে র্যাব ও পুলিশ।
রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত যদিও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী বা তৌহিদী জনতা জেলায় কোনো বিক্ষোভ মিছিল বের করেনি।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হয়। তার গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় উত্তেজনার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। কিন্তু সে ধরনের কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি।
জেলা শহরের কান্দিপাড়া এলাকায় রয়েছে জেলার অন্যতম বড় মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া। সেই এলাকার সড়কে দেখা যায়নি আলেম-ওলামাদের কোনো উত্তেজনা। জনসাধারণের চলাচলও ছিল স্বাভাবিক।
কান্দিপাড়া এলাকায় জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার সামনের সড়ক
কান্দিপাড়া সংলগ্ন শহরের টি. এ. রোডের পাশে ফারুকী বাজার, মার্কেট ও বিভিন্ন মুদি দোকান। কোনো ভয়-ভীতি ছাড়াই এসব বাজার ও দোকানে স্বাভাবিকভাবে কেনাকাটা করেছে সাধারণ মানুষ। শুধু তাই নয়, ফুটপাতের ওপর বসে বিভিন্ন সবজির পসরা সাজিয়ে বসে ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
এমনই একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সজল মিয়া। একটি মুদি দোকানের পাশে ফুটপাতে সবজি নিয়ে বসে ছিলেন। তাকে সাহায্য করছিল তার ছেলে উদয়। সে কাজীপাড়া দরগাহ মহল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।
হুজুররা ঝামেলা করতে পারে কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে উদয় বলে, ‘ডর কিয়ের। আর শহরো তো অনেক পুলিশ ঘুরাঘুরি করতাছে। কিচ্ছু হইত না।’
এ সময় পাশে থাকা তার বাবা সজল মিয়া বলেন, ‘লোকের মুখে হুনছি মামুনুল হক, জুনায়েদ আল হাবিব হুজুরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। শহরে এটাও বলাবলি আছে হুজুররা ঝামেলাও করত ফারে। কিন্তু কি করমু কন?
‘পেটে ভাত যাইতে হইলে তো এসব ভাবন যাইত না। লকডাউন না মাইন্না ফুটপাত বইয়া রইছি, ম্যাজিস্ট্রেট দেখলেই খালি দৌঁড়ানি দেই। হুজুররার ডর ত ভাই কাজ করে না।’
শহরের কান্দিপাড়া মোড়ের আরেক ব্যবসায়ী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে তো শহরের ভেতর অনেক থমথমে অবস্থা ছিল। হুজুরদের ঘটনায় শহরের সাধারণ মানুষ অনেক ভয়ে ছিল। সকলেরই মনে একটি আতঙ্ক ছিল, কখন যেন কী হয়।
‘তবে আস্তে আস্তে আমরা আবারও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছি। তবে যেহেতু মামুনুল হক গ্রেপ্তার হয়েছে তাই আবার হুজুররা মিছিল নিয়ে বের হতে পারে। তবে শহরে পুলিশ-র্যাব টহল দিচ্ছে। আশা করি খারাপ কিছু হবে না।’
শহরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের কড়া নিরাপত্তা দেখা গেছে। কাউতলী, কলেজপাড়া, টি. এ. রোড, কুমারশীল মোড়, মধ্যপাড়া বাসস্ট্যান্ডসহ শহরের সব প্রবেশপথে পর্যাপ্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। শহরের ভেতর প্রবেশ করার আগে প্রত্যেককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তা ছাড়া মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর র্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের কয়েকটি দল শহরের বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছে।
শহরে ঢোকার সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, আখাউড়া থেকে শহরে এসেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে। তবে কাউতলী দিয়ে শহরে ঢুকতেই আটকে দেওয়া হচ্ছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া কাউকেই শহরের ভেতর ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। যাকেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ ও গাড়িগুলোকে পরীক্ষা করে তারপর প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে।
শহরের সার্বিক পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোজাম্মেল হোসেন রেজা বলেন, ‘লকডাউন কার্যকরে আমাদের পুলিশ সদস্যরা মোতায়েন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চলমান কার্যক্রমেরই অংশ এই মহড়া। এটি ব্যতিক্রম কিছু না। যেকোনো অপ্রীতিকর ঘটনা কঠোরভাবে দমন করা হবে।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ত্রাস তৈরি করে হেফাজতের নেতা-কর্মীরা। ছবি: নিউজবাংলা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের দিন ঢাকায় বায়তুল মোকাররম মসজিদে সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাণ্ডব চালায় হেফাজতের নেতা-কর্মীরা।
সেদিন আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়, আগুন দেয়া হয় আনসার ক্যাম্পে। হামলা হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়েও।
শুধু তাই নয়, হেফাজত নেতা মামুনুল হকের ডাকে ২৮ মার্চের হরতালে আক্রমণ ছিল আরও ব্যাপক। জেলা পরিষদ পৌরসভা কার্যালয়, ভূমি অফিস জ্বালিয়ে দেয়া হয়। আক্রমণ হয় গ্যাস বিতরণ সংস্থা বাখরাবাদে। ভাঙচুর ও আগুন দেয়া হয় জেলা শহরে মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতিচিহ্নে। এমনকি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল, শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলকও ভাঙচুর করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৩৮টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাদের বাড়িঘরে চলে আক্রমণ।
হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন থানায় ৫৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে সদর মডেল থানায় ৪৯টি, আশুগঞ্জ থানায় ৪টি, সরাইল থানায় ২টি এবং আখাউড়া রেলওয়ে থানায় ১টি মামলা করা হয়। এসব মামলায় ৪১৪ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ৩৫ হাজার লোককে আসামি করা হয়।