বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ভালোবাসায় গড়েছেন দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ভান্ডার

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ১৫ এপ্রিল, ২০২১ ১৮:৪৩

আসলাম জানান, বাংলাদেশে লোকসংগীতের বিকাশ ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করছেন। বহু বাদ্যযন্ত্র নতুন প্রজন্মের চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তিনি সেগুলো তাদের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন। বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি এগুলো নিয়ে গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

ময়মনসিংহ নগরীর আকুয়া এলাকার বাসিন্দা রেজাউল করিম আসলাম। বর্তমানে বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ বিভাগীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

ছোটবেলা থেকেই বাদ্যযন্ত্রের প্রতি ছিল তার অগাধ ভালোবাসা। বিরল বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহের আসক্তি থেকেই আজ অবধি ছুটে চলেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বিভিন্ন জায়গা থেকে নষ্ট, ভাঙ্গা, পুরাতন বাদ্যযন্ত্রসহ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করেছেন। কেউ আবার নিজ উদ্যোগে সস্তায় কিংবা বিনা মূল্যে দিয়েছেন পছন্দের বাদ্যযন্ত্রটি। এভাবে সংগ্রহ করেছেন প্রায় ৬০০ বিরল বাদ্যযন্ত্র।

১৯৪৪ সালে দাদা নবাব আলী শহরের জি কে এম সি সাহা রোডের বড় বাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নবাব এন্ড কোং’ নামে একটি বাদ্যযন্ত্রের দোকান। দাদার মৃত্যুর পর বাবা জালাল উদ্দিন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসাটি পরিচালনা করেন। বংশপরম্পরায় স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ১৯৯২ সালে বাবাকে সহযোগিতা করতে ব্যবসায় যোগ দেন আসলাম।

দোকানে অনেক পুরাতন বেহালা, সেতার ও তানপুরা পড়ে থাকতে দেখে সেগুলোর যত্ন নিতে শুরু করেন তিনি। এক সময় ঐতিহ্যবাহী এসব বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়। বর্তমানে রেজাউল করিম আসলাম এই দোকানের স্বত্বাধিকারী।

‘নবাব অ্যান্ড কোং’ নামে দোকানটিতে গিয়ে দেখা যায়, দোকানটি এখন আর শুধু দোকান নয়, পরিপূর্ণ একটি বাদ্যযন্ত্রের ভান্ডারে পরিণত হয়েছে। এগুলো সংগ্রহে রাখার জন্য ইতিমধ্যে তিনি ‘এশিয়ান মিউজিক মিউজিয়াম’ নামে একটি জাদুঘর গড়ে তুলেছেন। নগরীর আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠের বিপরীত দিকে একটি গির্জার নিচতলায় এই জাদুঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। তবে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে এখন নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে।

কথা হয় আসলামের সাথে। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, বাংলাদেশে লোকসংগীতের বিকাশ ও ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করছেন। মূলত শখের বশেই বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করেন তিনি। বহু বাদ্যযন্ত্র নতুন প্রজন্মের চোখের আড়ালে থেকে যাচ্ছে। তিনি সেগুলো তাদের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করছেন। বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি এগুলো নিয়ে গবেষণাও চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এখন পুরাতন ভাঙ্গা বাদ্যযন্ত্র মেরামত করার কারিগররাও হারিয়ে যাচ্ছেন। ফলে নিজেই বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র মেরামত করছেন।

তিনি আরও জানান, জাতীয় জাদুঘরের ২৮ নম্বর গ্যালারিতে তার সংগ্রহে থাকা ৩২টি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া ‘নোভিস ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সাংস্কৃতি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছেন। ‘নোভিন আর্টিস্টিক এডুকেশন সেন্টার’ নামের একটি শিক্ষালয়ও পরিচালনা করছেন। সেখানে উপমহাদেশীয় ও পাশ্চাত্য রীতির সমন্বয়ে সংগীত, নৃত্য, চারুকলা, গিটার, বেহালা এবং দোতারার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

আসলাম সবচেয়ে বেশি বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে। এ ছাড়া যাদের কাছে ভাঙা, পুরাতন বাদ্যযন্ত্র নষ্ট হয়ে পড়ে আছে তারা মেরামত করতে আসে। আবার অনেকে যৎসামান্য টাকায় বিক্রি করে দেয় অথবা বিনা মূল্যে দিয়ে দেয়। করোনা মহামারি শেষ হলেই সংগ্রহে থাকা বাদ্যযন্ত্রগুলোর স্থায়ী প্রদর্শনী করা হবে বলেও জানান তিনি।

আসলামের সংগ্রহে থাকা বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে রয়েছে- একতন্ত্রী বীণা, সেতার, সারেঙ্গি, এসরাজ, তম্বুরা, বেহালা, গোপীযন্ত্র, ব্যাঞ্জো, সারিন্দা, আনন্দ লহরি, সুরবাহার, ম্যান্ডেলিন, তুবড়ি, বাঁশি, শঙ্খ, সানাই, ক্ল্যারিওনেট, ট্রাম্পেট, হারমোনিয়াম, প্রেমজুড়ি, নাকাড়া, ঢোল, ডমরু, খঞ্জরি, মৃদঙ্গ, তবলা, ঝাঁঝর, ঘণ্টা, খঞ্জনি, করতাল, ঘড়ি, কৃষ্ণকাঠি, মেকুড়, নূপুর, সেকাস, পাখোয়াজ ও শারদ, চেম্পারেঙ, দভণ্ডি, চিকারা, যোগী সারঙ্গী, মুগরবন, অ্যাকোর্ডিয়ান, ঘেরা, পেনা, শিঙা ইত্যাদি।

এগুলো ছাড়াও আসলামের সংগ্রহে জলসাঘরের তৈজসপত্রও আছে। এর মধ্যে রয়েছে - ফুলের সাজি, ফুলদানি, প্যাঁচানো ফুলদানি, সুরাপাত্র, ঘণ্টা, হুঁকো, তামাপাত্র, পানিপাত্র, মোমদানি, দেয়াল নকশি, খানদানি হুঁকো, পিকদানি, ছাইদানি, দুধপাত্র ইত্যাদি।

সংগৃহীত বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে আসলাম ২০০৩ সালে ময়মনসিংহ লোকজ মেলায় প্রথম প্রদর্শনী করেন। এরপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই বিভিন্ন উৎসবে বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শন করে আসছেন।

২০০৪ সালে প্রদর্শনী করেন জয়নুল সংগ্রহশালায়। ২০০৬ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে ঢাকার বৈশাখী উৎসবেও আসলাম যন্ত্রগুলো প্রদর্শন করেন। ২০০৮ সালে জয়নুল উৎসব, ২০১২ সালে মোতাহার হোসেন বাচ্চুর জন্মবার্ষিকী, ২০১২ সালে হালুয়াঘাটে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহে, ২০১৬ সালে ঢাকায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উচ্চাঙ্গসঙ্গীত উৎসব, ২০১৭ সালে সিলেটে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের লোকজ উৎসবে আসলাম তার বাদ্যযন্ত্রগুলোর প্রদর্শন করেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে জাতীয় জাদুঘরের ২৮নম্বর গ্যালারিতে ৩২টি পুরনো বাদ্যযন্ত্র প্রদর্শন করেন।

২০১৯ সালে হালুয়াঘাটের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরে তিনি তার সংগ্রহশালা থেকে বাদ্যযন্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ ও যুদ্ধাস্ত্রসহ ১৪৯টি নিদর্শন দান করেন।

ছায়ানট সাংস্কৃতিক সংস্থা ময়মনসিংহের সভাপতি আপেল চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, বাদ্যযন্ত্র সংগ্রাহক রেজাউল করিম আসলামের কাজগুলো সত্যিই প্রশংসনীয়। বাদ্যযন্ত্রের প্রতি ভালোবাসা থেকেই দূরদূরান্ত থেকে তিনি ভাঙ্গা, নষ্ট, পুরাতন বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের অনেকই দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের নামই জানে না। তাই সংগৃহীত দেশীয় বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে একটি জাদুঘর তৈরি হলে নতুন প্রজন্ম বাদ্যযন্ত্রের ধারণা ও ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারবে। এ ছাড়া বাংলার সংস্কৃতি ধরে রাখতে দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার প্রয়োজন।’

ময়মনসিংহ বহুরূপী নাট্য সংস্থার সচিব শাহাদাত হোসেন খান হীলু বলেন, ‘এখনকার অনেক ছেলে-মেয়ে একতারা চিনে না। বিদেশি ও আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার কমে যাওয়াসহ এর প্রদর্শনী নেই বললেই চলে। আলী আসলামের এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।’

এ বিভাগের আরো খবর