রংপুরে ১৯৯৫ সালে যখন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন হয়, তখন এর একটি আদালত ছিল। বিচারক ছিলেন একজন। ওই একজনের আদালতে চলত আট উপজেলায় ঘটে যাওয়া এ ধরনের সব মামলার বিচার।
মামলার সংখ্যা তখন এত বেশি ছিল যে, কোনো কোনো মামলা বছরে একবার শুনানির সুযোগ ঘটত। আসামি একবার জামিন পেলে বিচারপ্রার্থীর হতাশার অন্ত থাকত না।
২০১৮ সাল পর্যন্ত এভাবেই চলেছে। মামলা জমে জমে ৭ হাজার ৯৭১টি মামলার স্তূপ তৈরি হয় এ আদালতে।
এরপর পরিস্থিতি বদলে যেতে শুরু করে। ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর রংপুরে তিনটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এরপর গত আড়াই বছরে এই তিন আদালতে ৯ হাজার ৯৬০ মামলার মধ্যে ২ হাজার ১৮৯টির নিষ্পত্তি হয়েছে।
মামলাজট, বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি, আর্থিক ব্যয় এসব নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখির কারণে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বিষয়টি সরকারের উচ্চপর্যায়ে জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত হয় তিনটি ট্রাইব্যুনাল।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের সরকার পক্ষের আইনজীবী জাহাঙ্গীর হোসেন তুহিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সময় বদলে গেছে। একটি মামলায় বছরে চারবার বা পাঁচবারও তারিখ পড়ছে, শুনানি হচ্ছে। সে কারণেই দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে। মামলার বাদী এবং পুলিশ সঠিক সময়ে সাক্ষী হাজির করতে পারলে আরও দ্রুত বিচার শেষ করা সম্ভব।’
উদাহরণ দিতে গিয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন তুহিন বলেন, রংপুরের পীরগাছায় ২০১৯ সালের অক্টোবরে এক শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরের দিন মামলা হলে পুলিশ ২০২০ সালের ৩১ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ওই মামলায় ১২ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন শুধু তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য বাকি আছে। তার সাক্ষ্য পেলেই মামলার আরগুমেন্ট তৈরি হবে আদেশের জন্য। এমন অনেক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হচ্ছে।
৯টি আমলি আদালত নিয়ে রংপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২৭ হাজার ৯৫৮টি।
রংপুর জজ আদালতে বিচারাধীন মামলা ২৪ হাজার ৫৮২টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৫ হাজার ৮০৫টি আর ফৌজদারি মামলা ৮ হাজার ৭৭৭টি।
গত ২৪ মার্চ বিকেলে আদালত চত্বরে নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় এক ব্যক্তির। তিনি বলেন, ২০২০ সালের শুরুতে তার ছোট মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হন এক বয়স্ক ব্যক্তির কাছে। তিনি মামলা করেছেন। এখন সেই মামলা বিচার ফাইলে উঠেছে। তিনি আশা করেন, এ বছরের মাঝামাঝি মামলার রায় ঘোষণা হতে পারে।
এমন অনেক বিচারপ্রার্থীর সঙ্গেই কথা হয়। যেসব মামলা দশ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে, খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সেগুলোর বেশির ভাগেরই বাদী এবং পুলিশ সাক্ষী হাজির করতে পারছে না।
রংপুর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হক প্রামাণিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগের তুলনায় সাক্ষীর উপস্থিতি অনেক গুণ বেড়েছে। বিচার বিভাগ পৃথককরণের পর বিচারকরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছেন কম সময়ের মধ্যে যেন মামলা নিষ্পত্তি করা যায়।’
অন্য আদালতে মামলাজট সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘অনেক ফৌজদারি মামলা আছে, যেগুলোর নিষ্পত্তি প্রায় শেষ, অথচ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যের অভাবে বছরের পর বছর তারা ঘুরছে। আবার অনেক মামলা রয়েছে, যেগুলোর ফরেনসিক চিকিৎসককে সময়মত পাওয়া যায় না। সে কারণে আট থেকে দশ বছর লেগে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আজ (২৪ মার্চ) একটি ক্রিমিনাল মামলার একজন চিকিৎসক ৮ বছর পর এসে সাক্ষ্য দিলেন। যদি তিনি আট বছর আগে সাক্ষ্য দিতেন, তাহলেতো মামলা আট বছর চলত না।’
রংপুর আদালতের সরকার পক্ষের আইনজীবী আব্দুল মালেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন আদালতে বিচারক সংকট নেই। মামলা জটের বিষয়ে যে খবরাখবর প্রকাশ বা প্রচার করা হচ্ছে, সেগুলো পুরনো মামলার। এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। পুলিশ সাক্ষী আনলে সেগুলো উপস্থাপন করছি। আমার বিশ্বাস, যেভাবে মামলা এগিয়ে যাচ্ছে তাতে আগামী দুই বছরের মধ্যে মামলার জট বলতে আর কিছুই থাকবে না।’