ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার দুই বছর পূর্ণ হলো শনিবার।
আলোচিত এ ঘটনার দ্বিতীয় বার্ষিকীতে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন নুসরাতের স্বজনরা।
হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, হাইকোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে ডেথ রেফারেন্স।
২০১৯ সালের মার্চে ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনে নুসরাত। বিষয়টি মামলা পর্যন্ত গড়ায়; গ্রেপ্তার করা হয় অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে।
এরপর ওই বছরের ৬ এপ্রিল নুসরাত মাদ্রাসায় পরীক্ষা দিতে গেলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নিয়ে যায় সহপাঠীরা। সেখানে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলা তুলে নেয়ার জন্য তাকে চাপ দেয়া হয়। রাজি না হওয়ায় গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া হয়।
এতে পুড়ে যায় নুসরাতের শরীরের ৮৫ শতাংশ। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল অধ্যক্ষ সিরাজকে প্রধান আসামি করে আটজনের নামসহ অজ্ঞাতপরিচয় চার থেকে পাঁচজনকে আসামি করে মামলা করেন। নুসরাতের মৃত্যুর পর এটি হত্যা মামলা হয়ে যায়।
বিচারিক কার্যক্রম
মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হাফেজ আহমেদ জানান, ২৮ মে অভিযোগপত্র জমা দেয়ার পর ২০ জুন অভিযোগ গঠন করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। ৬১ কার্যদিবসে ৮৭ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়ার পাশাপাশি যুক্তিতর্ক হয়।
২৪ অক্টোবর ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ। একই সঙ্গে প্রত্যেক আসামিকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়।
দণ্ডিত চার আসামি আইনজীবীর মাধ্যমে খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেছেন। বাকি ১২ জন কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেল আপিল করেছেন।
২৯ অক্টোবর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স বা মৃত্যুদণ্ডাদেশের অনুমোদন চেয়ে হাইকোর্টে মামলাটি পাঠানো হয়েছে।
ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় কার্যক্রম উচ্চ আদালতে পাঠাতে হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী হাফেজ আহমেদ জানান, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই মামলার যাবতীয় নথির পেপারবুক ছাপানো হয়েছিল। পরে তা শুনানির জন্য বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকারের বেঞ্চকে দেয়া হয়। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সেই বেঞ্চ বাতিল হয়ে যাওয়ায় শুনানি হয়নি।
বাদীপক্ষের আইনজীবী শাহজাহান সাজু জানান, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হবে। মহামারির সময়ে রাষ্ট্র কিছু আসামিকে সাধারণ ক্ষমা করলেও এই মামলার আসামিরা এই ক্ষমার আওতায় আসবেন না।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন, পৌর কাউন্সিলর ও সাবেক পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোকসুদ আলম, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার বহিষ্কৃত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলা, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন, হাফেজ আবদুল কাদের, আবছার উদ্দিন, আবদুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মহিউদ্দিন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার বহিষ্কৃত অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলা
ফেনী জেলা কারাগারের সুপার আনোয়ার ফারুকী জানান, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে রুহুল আমিন ও মোকসুদ আলমকে ফেনী কারাগারে রাখা হয়েছে। কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা ওরফে পপি আছে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে। বাকিদের রাখা হয়েছে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে।
নুসরাতের মা শিরিন আক্তার জানান, করোনায় মারা গেলে মনকে সান্ত্বনা দেয়া যেত। কিন্তু খুনিরা নির্মমভাবে হাত বেঁধে জীবিত অবস্থায় তাকে হত্যা করেছে। তাদের ফাঁসির দণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হোক।
তিনি বলেন, দুটি বছর নির্ঘুম রাত পার করছেন। মেয়ের ঘরেই তিনি ঘুমান। মেয়ের মৃত্যু যন্ত্রণার সেই চারটি দিন ছিল তার কাছে বিভীষিকার। সেই ভয়াল দিনগুলো চোখে ভেসে এলে আর ঘুমাতে পারেন না।
মামলার বাদী নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, ‘আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায়বিচার পেয়েছি। উচ্চ আদালতেও আমরা ন্যায়বিচার প্রত্যাশী।’
তিনি আরও বলেন, ‘খুনি ও তাদের স্বজনরা ফেসবুকে ফেক আইডির মাধ্যমে আমাদের পরিবারকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে।’