গাইবান্ধা সদর উপজেলার একটি গুচ্ছগ্রামে আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর হস্তান্তরের আগেই ভেঙে পড়েছে। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঘরের পিলার, উড়ে গেছে টিনের চাল। আতঙ্কিত হয়ে অনেক সুবিধাভোগী ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যত্র।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর সাহায্য চাইতে গেলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাদের লাঞ্ছিত করেন। তিনি বলেন, ‘আরও কী চান! মরার জায়গাটাতো পেয়েছেন।’
গত ৪ এপ্রিল গাইবান্ধায় ঝড় আঘাত হানে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বালাআটা বাজার সংলগ্ন গুচ্ছগ্রামের ৪২টি ঘরের মধ্যে ১০টি। এখন চলছে এসব ঘর মেরামত। এই সংস্কার কাজেও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে।
বাসিন্দাদের কয়েকজন বলেন, ‘ঘরের কাজ করা হয়েছে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে। কোনোমতে সিমেন্ট মিশিয়ে অতিরিক্ত বালু দিয়ে তৈরি করা হয়েছে এসব ঘর। খরচ কমাতে দক্ষ মিস্ত্রীর পরিবর্তে অদক্ষ কর্মীদের দিয়ে নির্মাণ শেষ করা হয়েছে। শুকনো কাঠের বদলে ব্যবহার করা হয়েছে কাঁচা ও নরম জাতীয় কাঠ।’
তবে এসব অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ইউএনও। লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ঘর নির্মাণে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।
আর ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামতে কোনো দায়বদ্ধতা নেই উল্লেখ করে ইউএনও বলেন, তারপরও ঘর ঠিক করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সুবিধাভোগী শ্রমিক মোস্তফা মিয়া আগে বসবাস করতেন বাঁধের রাস্তায়। সপ্তাহ দুই-এক আগে তিনি এই গুচ্ছগ্রামে আসেন পরিবার নিয়ে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকার এখানে আমাদের ঘর দিছে। আমরা নিরাপদ মনে করে আসছি। কিন্তু এখানে এসে দেখছি, নিরাপত্তা তো নাই, আমাদের মরার ব্যবস্থা করে দিছে। এখানে এমন নরমল কাজ করে দেয়া হইছে; বিল্ডিং ভাঙগি গেছে, ছাদ পর্যন্ত উড়ি গেছে। আমরা বউ-বাচ্চা নিয়ে কেউ মসজিদে উঠছি; কেউ স্কুলে দৌঁড়াইছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘‘আমরা টিএনও (ইউএনও) সাহেবের কাছে গেছি। টিএনও সাহেব বলছে, ‘তোমরা তো একটা মরার জায়গা পাইছ।’ তাইলে এখানে যেহেতু টিএনও সাহেব নিজে কাজ করছেন, তাইলে টিএনও সাহেব কী আমাদের এখানে মরার ব্যবস্থা করে দিছেন। ঘর তো দিছে প্রধানমন্ত্রী, উনি (ইউএনও) এ কথা কেমনে বলতে পারে।’’
গেল রোববারের ঝড়ে গাছচাপা পড়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলায় ৫ জন, পলাশবাড়িতে ৩ জন, ফুলছড়িতে ২ জন, সুন্দরগঞ্জে ১ জন ও গোবিন্দগঞ্জে ১ জনসহ নারী ও শিশুসহ মোট প্রাণহানি হয়েছে ১২ জনের।
ঝড়ে জেলায় ধান, ভুট্টা ও শাকসবজিসহ প্রায় সাড়ে আট শ হেক্টর জমির নানা ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া শুধু সদর উপজেলায় ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে অন্তত দুই হাজার। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুতের খুঁটি, গাছপালা ও সরকারি স্থাপনাসহ বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
গুচ্ছগ্রামের ফয়জার রহমান বলেন, ‘ঝড়ির (ঝড়) মধ্যে এটি আছনো (থাকা) বউ-ছোল নিয়ে। কিছুক্ষণ পর ঘর-দুয়ের আউলি (ভেঙে) গেল; তখন সবাই মিলি দৌঁড় মারি স্কুলের বারান্দাত উঠনো। সেটি থাকি দেখি, টিন আসতা (সড়ক) মুখী দৌঁড় মারছি। এই ঘর তখন উড়ি যায়য়া ওই পাকত (ওই দিক) পড়ছি। টিন এখান চলি গেছি।
‘তখন হামরা ভয়তে (ভয়) আর দৌঁড়ের পাই নাই। বলে টিন তো গাওত (শরীরে) পড়বে। তখন স্কুলের মদে (মধ্যে) খুসেছি (লুকানো); তুফেনত (ঝড়)। কাম করছে নরমল; সেই তো ঘরগুলে চলি গেল (ভেঙে গেল)।’
নব্বই বছর বয়সী কাছলেনী বেওয়া বলেন, ‘তুফেনত ঘর ভাঙি পড়ে। এটি তো মরি যাম বাবা। মুই এটি আর থাকপের নম। মোক নিয়ে যা এটি থাকি।’
এই পাড়ার হাজেরা বেগম, রহিমা বেওয়া, বাদশা মিয়া ও জাফর আলীসহ অনেকেই আগে বসবাস করতেন অন্যের বাড়ি আর রাস্তার ধারে ঝুঁপড়িতে। তারা দুই সপ্তাহ আগে এখানে আশ্রয় পেয়েছেন। বৈশাখের আগে ওই ঝড়ের আঘাতে এখানকার সব কিছু হয়েছে লণ্ডভণ্ড। এখন তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে ভয়। সবার চোখে মুখে অজানা আতঙ্ক।
তারা অভিযোগ করে বলেন, সরকারিভাবে ৪২টি পরিবারের ঠাঁই হয়েছে এই গুচ্ছগ্রামে। অনেকে থাকার জায়গা পেয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এক ঝড়ে তাদের স্বপ্ন ভেঙে গেছে। তারা এখন আতঙ্কে দিন পার করছেন। অনেকেই ঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, ‘একটি টয়লেটেও দেয়া হয়নি গ্যাসলাইন পাইপ। এ কারণে ১৫ দিন ব্যবহারেই ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। আশ্বাস দিয়েও তাদের রাস্তা নির্মাণ করে দেয়া হয়নি। পর্যাপ্ত টিউবওয়েল নেই। অনেকে অন্যের বাড়িতে গিয়ে সারছেন গোসল ও কাপড় কাচার কাজ।’
ওই ঝড়কে টর্নেডো আখ্যা দিয়েছেন স্থানীয় লক্ষ্মীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বাদল। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘কাজ যথা নিয়মেই হয়েছে। যেদিন টর্নেডো হয় সেদিন নট ওনলি গুচ্ছগ্রাম, বাট অলসো টোটাল সদর উপজেলার তিন হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা কিন্তু যেনতেন টর্নেডো হয়নি। পরের দিন ইউএনও স্যারসহ পিআইও সাহেব এখানে পরিদর্শন করে। দ্রুত সেটা বাস্তবায়নে হস্তক্ষেপও নিয়েছেন ইউএনও।
ভয় ও আতঙ্কে অনেক সুবিধাভোগী ঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন, এ প্রশ্নে চেয়ারম্যান বলেন, ‘আসলে সেটা নয়; আমরা ঘর যখন ডেলিভারি দিছি, অনেকেই ঘর বুঝে নেয়নি।’
নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় ঝড়ে ঘর ভেঙে গেছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা সত্য নয়। বাজেটের মধ্যেই কাজ হয়েছে। মাত্র ১ লাখ ৯০ হাজার টাকা দিয়ে এই ধরনের ঘর করা সম্ভব না। তারপরেও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) অনেক মেধা সম্পন্ন ব্যক্তি হওয়ায় এটা সম্ভব হয়েছে।’
ইউএনও আব্দুর রাফিউল আলম বলেন, ‘ঝড়ে গাইবান্ধায় তিন হাজারেও অধিক বাড়ি উড়ে গেছে। এ রিপোর্ট আমরা পাঠিয়েছি। শুধুমাত্র ওখানে নয় (বালাআটা গুচ্ছগ্রাম), এক জায়গায় সাতটা ইটের ঘর ভেঙে গেছে।
‘টর্নেডো তো এমন নয় যে, মুজিববর্ষে গৃহহীন যারা, সেগুলোতে লাগবে না; বিষয়টা কী এ রকম? এগুলো রিপিয়ারিং (মেরামত) করার কথা না, তারপরেও তারা ভূমিহীন আশ্রয় গ্রহণকারী; যে কারণে আমরা নিজস্ব উদ্যোগে সেগুলো রিপিয়ারের ব্যবস্থা নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘এটা তো নেগেটিভ রিপোর্ট বা রিপোর্ট করার কিছু নাই। তিন হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হইছে, এগুলোতে রিপোর্ট করতে হবে আপনাকে।’
পিআইও আনিছুর রহমান বলেন, ‘জেলায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার ঘর পড়ে গেছে। ওখানে (গুচ্ছগ্রাম) তিনটা ঘর পড়ে গেছে।’
নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করে ঘর নির্মাণের অভিযোগের বিষয়ে পিআইও বলেন, ‘ওগুলো ছিল লো-কস্টিংয়ের ঘর। এজন্য ঘরগুলো হালকা। ঘর তৈরির নীতিমালায় বালু ও সিমেন্টের রেশিও ১:৬ বলা আছে; তবে কাজ হয়েছে ১:৫। অর্থ্যাৎ ডিজাইন ও প্ল্যানের চাইতে বেশি সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক আবদুল মতিনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোনে সাড়া দেননি।
জানুয়ারিতে সারা দেশে প্রথম দফায় প্রায় ৭০ হাজার ভূমিহীন-গৃহহীন পরিবারকে ঘর উপহার দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর এটি বাস্তবায়ন করছে আশ্রয়ণ প্রকল্প ২। প্রতিটি ঘরের জন্য পরিবহন খরচসহ ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।