ফরিদপুরের সালথায় সহিংসতার ঘটনায় আহত আরেকজনের মৃত্যু হয়েছে। তার নাম মিরান মোল্যা। বাড়ি উপজেলার ভাওয়াল ইউনিয়নের দরজাপুরুরা গ্রামে।
বুধবার দুপুরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মিরান মোল্যা। তার বয়স হয়েছিল ৩২ বছর।
তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভাওয়াল ইউপি চেয়ারম্যান ফারুকুজ্জামান ফকির মিয়া। এ নিয়ে এ ঘটনায় দুইজনের মৃত্যু হলো। অপরজনের নাম জুবায়ের হোসেন।
এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, মো. আব্দুর রহমান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এস এম কামাল, ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমসহ অন্য নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন।
এর আগে বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মাসুদ হোসেন, মহিলা আ.লীগ নেত্রী আইভি মাসুদ, জেলা আ.লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হক, দিপক মজুমদারসহ যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা।
এদিকে সালথায় সহিংসতার ঘটনায় চার হাজার ৮৮জনকে আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ। বুধবার সকাল ৮টায় সালথা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মিজানুর রহমান মামলাটি করেন। এতে ৮৮ জনের নাম উল্লেখ কররা হয়েছে এবং চার হাজার জনকে অজ্ঞাত হিসেবে দেখানো হয়েছে। সহিংসতার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এলাকা থমথমে এবং পুরুষশূন্য হয়ে গেছে।
ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জামাল পাশা বলেন, মামলায় থানায় হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৩ জনকে। বাকিদের ধরতে অভিযান চলছে।
সোমবার রাতে তিন ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চালায় হামলাকারীরা। ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত উপজেলা চত্বরে লাঠিসোঁটা নিয়ে ঢুকে থানা, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, উপজেলা কৃষি অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত এই এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালও ভাঙচুর করা হয়েছে।
তাৎক্ষণিকভাবে জানা গিয়েছিল, লকডাউন কার্যকর করার চেষ্টায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্থানীয়দের বাগবিতণ্ডাকে কেন্দ্র করে এই ঘটনা ঘটেছে।
তবে হামলাকারীদের উন্মত্ততা দেখে এই তথ্য কতটা সঠিক, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
তাণ্ডবের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাসলিমা আলী ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আসলাম মোল্লাকে প্রধান করে ছয় সদস্যের দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ে কাজও শুরু করেছেন।
সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হাসিব সরকার বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি হামলাকারীরা পুলিশের গুলিতে দুইজন নিহত এবং এক মাওলানাকে গ্রেপ্তারের গুজব ছড়ায়।’
সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ফুকরা বাজার থেকে নটাখোলা গ্রামের মো. জাকির হোসেন মোল্যা বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় সেখানে লকডাউনের পরিস্থিতি পরিদর্শনে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মারুফা সুলতানা খান হিরামণি যান।
জাকির হোসেনের অভিযোগ, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সহকারী কমিশনারের গাড়ি থেকে নেমে এক ব্যক্তি তার কোমরে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। এখান থেকেই সহিংসতার সূত্রপাত।
তবে ইউএনও হাসিব সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সরকারি নির্দেশ পালন করতে ওই বাজারে যান সহকারী কমিশনার (ভূমি)। সেখানে তিনি যাওয়ার পর মানুষের জটলা সৃষ্টি হয়। তখন তিনি ওই স্থান থেকে ফিরে এসে সেখানে পুলিশের একটি দল পাঠান। পুলিশ যাওয়ার পর স্থানীয়দের সঙ্গে পুলিশের বাগবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে এসআই মিজানুর রহমানের ওপর হামলা চালান স্থানীয়রা। হামলায় মিজানুর রহমানের মাথা ফেটে যায়।
‘পরে পুলিশের গুলিতে দুইজনের মৃত্যু ও এক মাওলানাকে গ্রেপ্তারের গুজব ছড়ানো হয়। এমন খবরে হাজারো মানুষ থানা ঘেরাও করে। পরে উপজেলা পরিষদ, থানা, সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, উপজেলা কৃষি অফিস, সাবরেজিস্ট্রি অফিস, উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়।’
সালথা উপজেলা চেয়ারম্যান ওয়াদুদ মাতুব্বর বলেন, ‘আমার বাসভবনসহ বিভিন্ন অফিস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। গুজব ছড়িয়ে এ হামলা চালানো হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের নেতা-কর্মীরা এই হামলা চালিয়েছে।’
পুলিশ সুপার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, ‘লকডাউনের প্রথম দিনে সরকারি নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভুল বোঝাবুঝি হয়। একপর্যায়ে স্থানীয়রা মিজানুর নামে এক এসআইকে মারধর করে। এরপর তারা গুজব ছড়িয়ে পরিকল্পিতভাবে হামলা করে।’
তিনি বলেন, ‘তাদের এই হামলা থেকে রক্ষা পায়নি উপজেলা কমপ্লেক্সের গাছপালা, বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ নানা স্থাপনা। এটি সাধারণ মানুষের কাজ হতে পারে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা জানান, হামলার সময়কার ভিডিও ফুটেজ পেয়েছেন তারা। সেখান থেকে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।
অপরদিকে ধংসযজ্ঞ শেষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও এলাকার অবস্থা এখনো থমথমে। উপজেলা পরিষদজুড়ে এখনও আছে হামলার চিহ্ন। উপজেলা সদরের বাতাসে পোড়া গন্ধ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভাঙা কাঁচ আর আসবাবপত্রের টুকরা। মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। সহিংসতার ঘটনায় ৪ হাজারেরও বেশি লোককে আসামি করে মামলা হওয়ায় এলাকা পুরুষশুন্য হয়ে পড়েছে। সদর এলাকায় লোকজনের আনাগোনা একবারেই নেই বললেই চলে। রাস্তাগুলো একদম ফাঁকা।