অনেকের স্বামী অসুস্থ, কারো ভেঙেছে সংসার, আবার অনেকের স্বামী মারা গেছেন। কারও আবার পরিবারের সদস্য সংখ্যা অনেক। সংসার চালাতে ওই নারীরা বসেন বাজারে, বিক্রি করেন নানা রকম পণ্য। এভাবেই চলে ‘বউ বাজার’র বিক্রেতা নারীদের সংসার।
ময়মনসিংহ নগরীর কৃষ্টপুর এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও কাঁচা বাজার স্থানীয়দের কাছে ‘বউ বাজার’ নামে পরিচিত। এই বাজারের হর্তাকর্তা নারীরাই। এখানে কেউ বিক্রি করছেন সবজি, কেউবা মাছ-মাংস, কেউ কেউ করছেন মুদি দোকান।
তাদেরই একজন রাশিদা বেগম। আট বছর আগে তার স্বামী ফজলুল হক মারা যাওয়ার পর এক ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন রাশিদা। সংসারের এমন দুরবস্থায় নিজের কাঁধেই তুলে নেন সংগ্রামের চাকা।
তার আরেক বড় বোন বিধবা বানেছাকে সঙ্গে নিয়ে এই বাজারে এক হাজার টাকা পুঁজি দিয়ে শুরু করেন মুরগীর ব্যবসা। এর বদৌলতে আলোর মুখ দেখেছেন তিনি। ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন স্থানীয় একটি কলেজে।
নগরীর কৃষ্টপুর এলাকায় মালঞ্চ ও আদর্শ নামে দুই কলোনি ঘিরে গড়ে উঠে এই বউ বাজার। বাজারের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর আগে কয়েকজন নারী কলোনির রাস্তার পাশে বসে অল্প কিছু সবজি বিক্রি করতেন। কলোনির পাশে হওয়ায় বেচা-কেনা ভালো হতো। পরে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং তাদের দেখে অন্য নারীরা এগিয়ে আসে এই পথে। তাদের আগ্রহ দেখে তৎকালীন ময়মনসিংহ পৌরসভা প্রশাসন তাদের জন্য এখনকার বাজারের জায়গাটি নির্ধারণ করে দেন। এভাবেই এই বাজারের সূচনা।
শুরুতে পাঁচ-ছয়টি দোকান থাকলেও বর্তমানে সেই সংখ্যা শতাধিক। বাজারটিতে ব্যবসা করে ভাগ্য বদল হয়েছে অনেক নারীর।
বাজারের মাছ বিক্রেতা খোদেজা বেগম বলেন, ‘আমার আম্মা এই বাজারে দোকানদারি করছে, আমি আম্মার লগে বইতাম। আম্মার কাছতে আমি বিভিন্ন জিনিস শিখছি। দুই বছর আগে আমার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়। পুলাপান নিয়ে বিপদের মইধ্যে পইড়া যাই। আমার স্বামী এই বাজারেই মাছ বেচত। এহন আমি তার দোকানে বসি, হাতে টেহা পয়সা না তাহায় মহাজনরে কয়া বাকিতে মাছ আনি পরে এগুলা বেইচ্ছা বিকালে মহাজনরে দেই। যা লাভ (প্রতি মাছে তিন থেকে পাঁচ টাকা) হয় তা দিয়া সংসারের খরচ চলে। কারও কাছে হাত না পাইতা নিজে ইনকাম করি, এইডাই শান্তি।’
বাজারের এক নারী সবজি বিক্রেতা হাসিনা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী ভ্যান চালায়। আংগো দুই পোলা, এক মাইয়া। পাঁচ জনের সংসার, এক পোলা, এক মাইয়া ইস্কুলে পড়ে। এক জনের আয় দিয়া আংগো সংসার চলতাছিল না। ছোট ছোট বাচ্চা পোলাপান তয়া মাইনষের বাড়িত কামও করতে জাইতারি না। আমার স্বামী সকালে বাইর হয়া যায়, আয়ে রাইতে। পরে আর কোনো উপায় না পায়া এই বাজারে কাঁচা মালের দোহান দিসি। সকালে স্বামী পাইকারি বাজারতে মালামাল আইনা দেয়। পরে আমিই এগুলা গুছায়া বেচা-কিনা করি। স্বামী যা ইনকাম করে তা দিয়া ঘরভাড়া আর পুলাপানের খরচ করি, আমি যা লাভ করি তা দিয়া ভাত কাপড়ডা হয়। আর কিছু আয় থাহে।’
বাজারের আরেক মাছ দোকানি জাহান বেগম। অনেক আগে এই বাজারে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। বয়সের ভারে এখন খুব একটা কুলিয়ে উঠতে পারেন না। তাই নাতনি চম্পাকে সঙ্গে নিয়ে চালাচ্ছেন ব্যবসা।
তিনি বলেন, ‘অনেক বছর ধইরা এই বাজারে মাছ বেচি। আল্লাহ্ এহনও বাঁচায়া রাখছে তাই বাজারে ব্যবসা করি। পুলারা মাছ আইনা দেয়। নাতনিই সব করে, আমি দেহায়া দেই। সেই এহন বেচাকিনা করতারে।’
বাজারের এক কোনায় বিভিন্ন প্রজাতির শুটকি মাছ বিক্রি করেন হালিমা আক্তার। ১১ বছর আগে পরিবারের অনিচ্ছায় ব্যবসা শুরু করেন। এখন তার আয়ে সন্তানদের নিয়ে বেশ ভালভাবেই কাটছে তার সংসার। শুরুতে অমত ছিল স্বামী জয়নাল মিয়ার। তিনিই এখন মালামাল কিনে এনে দেন।
এই বাজারে বেশ কিছু পুরুষ বিক্রেতাও ইদানীং ব্যবসা শুরু করেছেন। আবার অনেকে অসুস্থতা কিংবা অন্য কোনো কারণে আসতে না পারলে স্বামী বা সন্তানরা দোকানে বসেন।
রাবেয়া আক্তার নামে এক নারী বললেন, ‘আমরা মিলে মিশেই বাজারে ব্যবসা করছি। এখানে সবাই কলোনির বাসিন্দা। পুরুষরাও মাঝেমধ্যে আমাদের সাহায্য করে।’
স্থানীয়ভাবে এই বাজারের জনপ্রিয়তা অনেক। প্রতিদিনই জমজমাট থাকা এ বাজারটিতে ক্রেতা হিসেবে পুরুষদের চেয়ে নারীদের সংখ্যাই বেশি।
বাজারের এক নিয়মিত ক্রেতা নাজমা আক্তার বলেন, ‘এই বাজারের বেশির ভাগ দোকানিই নারী। তাই আমরা এখানেই আসি, বেশ সুবিধা পাই।’
রেবেকা সুলতানা নামে আরেক নারী ক্রেতা জানান, এই বাজারটি হওয়ায় নারীদের জন্য খুবই সুবিধা হয়েছে। তারা এখানে বাজার করতে এসে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নারী বিক্রেতা ও অনেক নারী ক্রেতা থাকায় এখানে তারা নিরাপদও বোধ করেন।
চরপাড়ার বাসিন্দা শাহানাজ বলেন, ‘আমাকে প্রায়ই বাজার করতে হয়। প্রায়ই আমি এই বউ বাজারে আসি। এখানে নারী বিক্রেতা থাকায় সহজে দামাদামি করা যায়, কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব হয় না।’