সম্প্রতি উদযাপন করা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। কিন্তু সেই উৎসবের ছোঁয়া লাগেনি শরীয়তপুরের চার নারী মুক্তিযোদ্ধা (বীরাঙ্গনা) পরিবারের।
এখনও দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ তাদের। বসবাস পরের জমি, অন্যের ঘর আর বস্তিতে। যে দেশের জন্য হারিয়েছেন সব, সেখানে নিজের জন্য নেই এক চিলতে জমি।
স্বাধীন এই দেশে শেষ বয়সে নিজ জমিতে ঘর তুলে বসবাসের আকুতি অবহেলিত ওই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
‘দুপুর বারোডা বাইজগ্যা গ্যাছে রানতে অইবো, তয় চাউলগুন মাপি। ছেলেডায় আমার গারের উপর দারাইন্যা, আমার শাউরি বারিন্দায় বসা। হ্যাসে চাউল মাপতে নইছি পরেই পিছ মুইরা আইসা ধরছে, গেডি ধরছে। গেডি ধইরা বাইর করছে। আমার জালেগো, মামি শাউরিগো, দেওর ভাসুর সবাইরে, তিন বাড়ির মানুষ সব একখানে করছে। হ্যাসে আমাগো ধইরা নিয়া গেলো। রাস্তায় আমার দেওর তিনডারে মাইরা হালাইলো। আমাগো আংগাইরা নিয়া লঞ্চে উডাইছে। হেইআন থিকা মাদাইরপুর জুট মিলে নিয়া যায়। ওইখানে আমাগো নির্যাতন করছে। তিন দিন তিন রাইত আমাগো অত্যাচার করছে। অনেক কষ্ট দিছে অনেক শাস্তি দিছে। কত কানদোন আর চিৎকার শুনছি। অনেকেরে মাইর্যা হালাইলো। পুরুষগো তো আর রাহে নাই। তিন দিন পর আমাগো ছাইরা দেয়। ছেড়া কাপড় পইরাই বাড়িত আইছি। কতেক মুসলমানরা কাপড় দিছে। নাইয়া ধুইয়া হ্যাশে হেইয়া পরছি। বাড়িঘর কিচ্ছুই নাই সব পোড়াইয়া দিছে। ছাপড়ার নিচে বইয়া জাউ খাইছি।’-ছলছল চোখে কথা গুলো বলছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার শরীয়তপুরের মধ্যপাড়া গ্রামের বীরাঙ্গানা যোগ মায়া।
বীরাঙ্গনা ভানু বিবি
তিনি বলেন, ‘মাইনষের বাড়ি ভিক্কা করছি। কেউর চাউল ঝাইড়া দিছি। এমনেই দিন যায় রাইত পোহায়। রাইত পোহায় দিন অয়। হের পর দিলো তামু। হেইর নিচেই দিন কাডাইলাম। হেইপর ট্যাংগা আর তালপাতা দিয়া কোনো রহম গরটর উডাইয়া রইলাম।
‘অহনও কষ্ট অয় বাবা। পরের বাড়ি পরের গর। মনে অনেক কষ্ট। অহনও দিন কাটাইতাছি। কবে ইট্টু নিজা বাড়িতে থাইক্যা যামু।’
গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর ইউনিয়নের ভানু বিবি বেঁচে থাকলেও মাথা গোঁজার ঠাঁই না থাকায় চলে গেছেন রাজধানী ঢাকায়। সেখানে মিরপুরের গরীবে নেওয়াজ বস্তিতে খুপরি ঘরে থাকেন। দীর্ঘ ৫০ বছর তার কেটেছে দুঃখ আর কষ্টে।
মুঠোফোনে কথা হয় ভানু বিবির সাথে। তিনি বলেন, ‘যুদ্দের সময় মুক্তিবাহিনীকে সাহাইজ্জ করতাম। হেগো অসরো (অস্ত্র), খবর ও খাওন দিয়া আইতাম। একদিন এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে সেনারা আক্রমন করে। ওই খানে আমি ছিলাম। আমারে আটকাইয়্যা অত্যাচার করে। মুক্তিবাহিনীর কথা জানতে চায়। কই নাই। অসরের গোড়া (বেয়নেট) দিয়া অনেক আঘাত করছে। দ্যাশ পাওয়ার পর অনেক কষ্টে পোলাহান লইয়া দিন পার করছি। বস্তিতে থাকলেও মনে করি দ্যাশ তো সাদীন অইছে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় শরীয়তপুরে হিন্দু অধ্যুষিত মধ্যপাড়া গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদারেরা। পুড়িয়ে দেয় ঘর বাড়ি, ধরে নিয়ে যায় অসংখ্য নারী-পুরুষকে।
প্রয়াত বীরাঙ্গনা যুগল বালা পোদ্দার
মাদারীপুর এরআর হাওলাদার জুট মিলে নিয়ে পুরুষদের হত্যা করা হয়, আর নারীদের ওপর করা হয় নির্যাতন।
ওই নারীদের মধ্যে যুগল বালা পোদ্দার আর সুমিত্রা মালো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেয়েই মারা গেছেন। তাদের সন্তানরা দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছেন।
যুগলবালা পোদ্দার মারা যান ২০১১ সালে। মৃত্যুর সাত বছর পর ২০১৮ সালে তাকে দেয়া হয় নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। তারই ছেলে রতন পোদ্দারের পরিবারের এখনও থাকেন আত্মীয়ের ঘরে। জমি থাকলেও অর্থের অভাবে নির্মাণ করতে পারেনি বাড়ি।
রতন পোদ্দার বলেন, ‘যুদ্ধের সময় বয়স আমার আছিলো আসটো (আট) বছর। মা, বাবা, কাকারে ধইরা লইয়্যা যায় পাকিস্তানিরা। বাবা আর কাকারে নদীর পারে নিয়া মাইরা হালাইছে, মায় আমগো কইছে। ৪০ বচ্ছর ধইরা অনেক কষ্ট কইরা মায় আমাগো মানুষ কইরা মইরা গ্যাছে। অহনও আমি নিজের জায়গায় ঘর উডাইতে পারি নাই। পোলাপান পড়াতেই অনেক খরচ। চা বেইচ্যা সব সামলাইতে পারি না।’
প্রয়াত বীরাঙ্গনা সুমিত্রা মালো
১৯৭১ সালে সুমিত্রা মালো অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তাকেও ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। সঙ্গে নয় বছর ও ১১ বছরের দুই মেয়েকেও নিয়ে যায়। নির্যাতন শেষে তাদেরও ছেড়ে দেয়া হয়। অন্যের আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেন। সেখানে জন্ম দেন এক প্রতিবন্ধী শিশুর। কিছু দিনের মাথায় মারা যায় শিশুটি। কয়েক বছর পর মারা যান সুমিত্রার স্বামীও। কষ্টে বড় করেন দুই মেয়েকে। ২০১৪ সালে চলে যান না ফেরার দেশে।
সুমিত্রা মালোর মেয়ে বীনা মালো বলেন, ‘আমার মায় আক্ষেপ নিয়াই মরছে। জীবিত থাকতে হে কোনো সাইয্যোও পায় নাই আর বাইচ্যা থাকতে সরকারি কোনো সীরকিতিও (স্বীকৃতি) পায় নাই। হে মইরা যাওয়ার পর দুই বছর আগে মায়রে মুক্তিযোদ্ধার সীরকিত দিছে।’
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘স্বাধীনতার এই ৫০ বছর পরও কোনো নারী মুক্তিযোদ্ধার পরিবার অসহায় অবস্থায় রয়েছে, এ কথা আমাদের পীড়া দেয়। যাদের ত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা, তাদের কষ্ট মানা যায় না। এই চার নারী মুক্তিযোদ্ধার জন্য বীর নিবাস নির্মাণ করার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।’