কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের লাশকাটা ঘরে জনবল ও যন্ত্রপাতিসহ নানা সংকট চলছে। এতে ময়নাতদন্তে সময় বেশি লাগছে। পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তিনটি কক্ষ। একটিতে চলে মরদেহের হিসাব-নিকাশের কাজ। আরেকটি কক্ষে চলে মরদেহ কাটা-ছেঁড়ার কাজ। সেখানে স্ট্রেচারগুলোতে জং ধরে আছে। পানির কল নষ্ট। ওই কক্ষের একমাত্র শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রটি (এসি) বিকল।
অপর কক্ষটি হিমাগার। সেখানে মরদেহ রাখা হয়। সেখানে একটি ফ্রিজ আছে। এর ভেতরে চারটি মরদেহ রাখা যায়। ফ্রিজটি বছর খানেক ধরে বিকল। কক্ষটিতে কাজ না থাকায় ময়লা হয়ে আছে। লাশ কাটার পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় কক্ষটির ভেতর থেকে উৎকট দুর্গন্ধ বের হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কোনো মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে সাধারণত দুই-তিন ঘণ্টা লাগে। কিন্তু জনবল সংকটের কারণে এখন লাগছে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা। আর এ কারণে লাশকাটা ঘরের সামনে স্বজনদের ভিড় লেগেই থাকে। দুর্গন্ধে তাদের পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ।
মেঘনা উপজেলার আরিফ এসেছেন তার বাবার মরদেহ নিয়ে। তিনি বলেন, ‘ভাই লোক নাই। একজন ডোম আমার বাবার লাশটি টেনেহিঁচড়ে লাশকাটা ঘরে নিয়ে যেতে থাকেন। সহ্য করতে পারিনি। পরে আমি ডোমের সাথে ধরাধরি করে লাশটি ওই কক্ষে নিয়ে গেছি।’তিনি বলেন, ৭ ঘণ্টা পর তার বাবার মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়।
এদিকে আসমা নামের এক গৃহবধূ গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। সকাল ৭টায় তার মরদেহ আনা হয় এই মর্গে। বিকেল ৫টায় ময়নাতদন্ত শেষ হয়। এর আগে পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি, লাশকাটা মিলে এক দুর্বিষহ সময় পার করেন আসমার বড় ছেলে সাইফুল। বলেন, ‘মা মারা গেছে। তাকে আর ফিরে পাব না। তবে ময়নাতদন্ত করতে এসে কী যে ভোগান্তিতে পড়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। আর কেউ যেন আমার মতো ভোগান্তির শিকার না হন।’
কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি মাসে অন্তত ২০০ মরদেহ আসে। যেগুলোর বেশির ভাগই অর্ধগলিত। সেগুলো সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া দুর্গন্ধ দূর করারও কোনো কেমিক্যাল নেই এই লাশকাটা ঘরে।
মর্গের ডোম মাহে আলম বলেন, ‘ভাই আমি একজনই। কিতা করতাম কন। আমি একলাই লাশ কান্ধে কইরা লাশকাটা ঘরে লইয়া যাই। কোনো সুই নাই, সুতা নাই। আমার হাতমুজা নাই। টেফের ভিতরে পানি নাই। লাশের গন্ধে মাঝে মইধ্যে নিজেই বেহুঁশ হইয়া যাই। লাশের ঘরের ফ্রিজডাও নষ্ট।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বছরে গড়ে ১২০০ মরদেহ আসে এই মর্গে।
নাম প্রকাশ করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, বছর খানেক আগে এই লাশকাটা ঘরের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির জন্য আবেদন করা হলেও কাজ হয়নি। কোনো যন্ত্রপাতি দেয়নি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি নিয়ে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. শারমিন সুলতানা বলেন, ফরেনসিক বিভাগে কমপক্ষে সাতজন লোকবল দরকার। তাদের মধ্যে একজন অধ্যাপক, একজন সহযোগী অধ্যাপক, একজন সহকারী অধ্যাপক, একজন প্রভাষক, দুজন মেডিক্যাল অফিসার ও একজন ডোম সহকারী।
তিনি বলেন, ‘সেখানে আমি একজন সহকারী অধ্যাপক ও দুজন প্রভাষক দিয়ে কোনো রকম কাজ করছি। ২০১৫ সাল থেকে এভাবেই চলছে। এর মধ্যে যদি কোর্টে হাজিরা থাকে, তখন লাশকাটা ঘরের সামনে স্বজনদের ভিড় লেগে যায়। লাশকাটা ঘরে যন্ত্রপাতির সমস্যা হয়তো সমাধান করা যাবে। কিন্তু লোকবলের সমস্যা সমাধান না করলে ভবিষ্যতে কাজ করা দুরূহ হয়ে যাবে। খুব সমস্যায় আছি।’