ফেনীর ছয় উপজেলায় কৃষিজমির মাটি কেটে নেয়া হচ্ছে ইটভাটায়। এতে কৃষকরা সামান্য টাকা পেলেও অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে তাদের ফসলি জমির। বিষয়টা অনেক কৃষক বুঝতেই পারছেন না।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, জেলায় লাইসেন্সভুক্ত ইটভাটা আছে ১০৫টি। এর মধ্যে ফেনী সদরে রয়েছে ৫৯টি। দাগনভূঞায় ২৭টি। সোনাগাজীতে ৫টি, অন্য তিন উপজেলায় আছে ১৪টি। ৮ থেকে ১০ একর জমি ধ্বংস করে গড়ে ওঠে একেকটি ইটভাটা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবেও ফেনীতে ইটভাটার সংখ্যা ১০৫টি। এসব ইটভাটায় বছরে অন্তত দেড় কোটি টন মাটি লাগে। এ জন্য বছরে প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমি থেকে ২ ফুট গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নেয়া হয়।
জমির মালিকরা মাত্র ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা বিঘা হিসেবে মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন। মাটি কাটার ফলে জমির উপরিভাগে ৪ থেকে ৬ ইঞ্চির মধ্যে থাকা জমির খাদ্যকণা ও জৈব উপাদান নষ্ট হচ্ছে। ফেনীর গ্রামাঞ্চলে কৃষিজমির সবচেয়ে বড় সর্বনাশ ঘটাচ্ছে ইটভাটাগুলো।
ফসলি জমি ধ্বংস করে মাটি কাটা রোধে আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। প্রশাসনের তৎপরতা নেই।
গোহাডুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক খোন্দকার মহিউদ্দিন বলেন, একসময় মাঠের পর মাঠ সোনালি আমন ধান হতো। কৃষকের মুখে হাসি ফুটত। ধান মাড়াইয়ে কিষানিদের ব্যস্ততা, উঠানজুড়ে ধান শুকানো ও গোলা ভরা ধানের দৃশ্য গ্রামীণ জীবনে এখন শুধুই স্মৃতি। সোনা ফলানো সেই মাঠে ধান কাটার কাঁচির বদলে চলছে কোদাল আর ইটভাটার ট্রাক্টর। কৃষি ভূমি রূপান্তর হচ্ছে জলাশয়ে।
তিনি বলেন, কোথায়ও আবার গভীর গর্ত হয়ে যাওয়ায় সেসব জলশয়ে জাল দিয়ে মাছ ধরা হয়। মাটি কেটে নেয়ায় নিচু জমিগুলো পরিণত হয়েছে ছোট পুকুরে। এ দৃশ্য ফেনী জেলার অধিকাংশ গ্রামীণ এলাকায়। বিশেষ করে যেখানে ইটভাটা রয়েছে সেখানে। এত কিছুর পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইটভাটায় মাটি বিকিকিনি রোধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
প্রবীণ কৃষিবিদ আবদুল কাদের বলেন, ফেনী জেলার মানুষ প্রতিনিয়ত নির্মাণ করছেন বহুতল ভবন, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট। এ ইটের জোগান দিতে তৈরি গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত ইটভাটা। নগদ অর্থের লোভে কৃষিজমি থেকে ইটভাটায় মাটি বিক্রি করছেন।
রাতের অন্ধকারে কাটা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি
তিনি বলেন, জমির উপরিতলের মাটি কিনে নিলে উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায়, তাতে ফসলের উৎপাদন কমে যায়। এ ছাড়া জমি নিচু হয়ে যাচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমে এসব জমিতে ধান রোপণ করতে পারছেন না কৃষকরা।
সুজনের ফেনী জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন বলেন, আজ গ্রাম পরিণত হচ্ছে নগরে। ফলে হারিয়েছে যাচ্ছে কৃষিজমি। ইটভাটার মাটির জন্য প্রতি বছর হাজার হাজার একর আবাদি জমি অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে।
বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, অনেক ফসলি জমি এখন ফসলহীন ধু ধু নিচু মাঠ। কোথাও আবার পুকুরের মতো।
ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নের অলিপুর গ্রামের কৃষক আবদুল মান্নান বলেন, ‘পাশের জমির মাটি কেটে নেয়ায় তার জমিতে পানি ধরে রাখার স্বার্থেই কেটে সমান করতে হচ্ছে । জমি নিচু হয়ে যাওয়ায় ধান হয় না। ইটভাটায় মাটি বিক্রি রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো দরকার। ইটভাটা ও ভূমি মালিকদের জরিমানা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’
একই গ্রামের কৃষক আবদুর রউপ বলেন, শুধু ব্যক্তিপর্যায়ে লোভের কারণে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো আইনি ব্যবস্থা নেই।
ফেনীর শর্শদী ইউনিয়নের সুন্দরপুর গ্রামের কৃষক আবদুর রহমান ভূঞা বলেন, এভাবে জমির উপরিভাগের মাটি কাটা হলে কী ক্ষতি হয় তা কৃষকরা তেমন জানেন না। তবে কিছুটা ক্ষতি হচ্ছে এমন কথা স্বীকার করে বলেন, অনিচ্ছাসত্ত্বেও আর্থিক অনটনে পড়ে বাধ্য হয়ে তারা কৃষিজমির মাটি বিক্রি করছেন।
ফেনী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাসরিন সুলতানা বলেন, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এর ধারা ৫ অনুয়ায়ী কৃষিজমির মাটি কেটে ইট প্রস্তুত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কৃষিজমির হিউমাসসমৃদ্ধ উপরিতলের মাটি তৈরি হতে ২৫-৩০ বছর লাগে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের অবস্থান থেকে আমরা কৃষকদের বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু কাঁচা টাকার লোভে অনেকেই টপ সয়েল বিক্রি করে দেন। এ অবস্থায় আমাদের যার যার অবস্থান থেকে ইটভাটাগুলো যাতে আইন মানতে বাধ্য হয় সে জন্য কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
ফেনী সদর উপজেলার লেমুয়া এলাকার বাসিন্দা জহিরুল হক মিলন বলেন, মাটি বহনকারী ট্রাকের ভারে গ্রামীণ সড়কগুলোতে খানা-খন্দের সৃষ্টি হচ্ছে। অভিযোগ দিলেও মিলছে না সুফল। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হারাবে কৃষিজমি। তাই কৃষিজমির মাটি রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
ইটভাটার মালিক লিয়াকত আলী জানান, তারা অতিরিক্ত দাম দিয়ে কৃষকদের ম্যানেজ করে মাটি ক্রয় করছেন, জোর করে নয়। সরকার ইটভাটার অনুমোদন দিয়েছে, মাটি না পেলে তা কীভাবে চলবে?
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সহকারী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ-ফেনী) কামরুল হাসান বলেন, জমির উর্বরতাশক্তি উপরিভাগ থেকে ১৫-২০ ইঞ্চির মধ্যে থাকে। ওপর থেকে মাটি সরিয়ে ফেলায় শক্তি ফিরে আসতে ১০-১৫ বছর সময় লাগে।
ফেনী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক তোফায়েল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘মাটি কাটা রোধে শিগগির ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করা হবে।’