হেফাজতে ইসলামের ডাকা হরতালে সকাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরজুড়ে তাণ্ডবের পর পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছে।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন সরাইল উপজেলার সৈয়দটোলার আলামিন, কালোন মিয়া এবং খৈয়াসার এলাকার অজ্ঞাত এক ব্যক্তি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক শওকত হোসেন নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, পুলিশ লাইনস এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে হেফাজত কর্মীরা তেড়ে গেলে সেখানে সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষে কয়েকজন আহত হওয়ার পর তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনজনের মৃত্যু হয়।
টানা দুই দিন সরকারি স্থাপনায় হামলা, সংঘর্ষের পর হরতালেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিংস হয়ে উঠেছে হেফাজত সমর্থকরা।
হামলা হয়েছে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা, ঘরবাড়ি, আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাদের বাড়ি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়ে।
শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ চত্বরে আয়োজিত উন্নয়ন মেলায় আগুন দেয় হেফাজত কর্মীরা।
হেফাজত কর্মীদের একজোট আক্রমণ মোকাবিলায় পুলিশ কার্যত কিছুই করতে পারছে না।
সকালে শহরে যান চলাচল শুরু করলেও হেফাজতের সন্ত্রাসে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। বিভিন্ন এলাকায় দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। গাড়িগুলোকেও নিরাপদে সরিয়ে নেন মালিকরা।
টি.এ রোডে হেফাজত কর্মীদের বিক্ষোভ
সকালে শান্ত থাকলেও বেলা ১১টার পর বিভিন্ন কওমি মাদ্রাসা থেকে মিছিল নিয়ে বের হতে থাকে ছাত্ররা। হেফাজতে ইসলামের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতালে সকাল থেকে লাঠি হাতে পুরো শহরে মিছিল করেছে তারা।
বেলা ১১টার দিকে মিছিল করে পুরো শহরের বিভিন্ন জায়গায় রিকশার টায়ার, রাস্তার পাশে রাখা ইলেকট্রনিকস সামগ্রীতে আগুন দেয় মাদ্রাসা ছাত্ররা।
রাস্তার পাশের দোকান থেকে ফ্রিজ নিয়ে এসে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয় হেফাজত কর্মীরা
শহরের নিরাপত্তায় পুলিশ, র্যাব মোতায়েন থাকলেও আগের দিনের সহিংসতার পর আধা সামরিক বাহিনী বিজিবিকে দেখা যায়নি। পুলিশ যেখানে মোতায়েন ছিল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেখানেও তারা কোনো অ্যাকশনে যায়নি।
জেলা পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় এবং সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি ও কার্যালয়ে, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বাড়িতে, ভূমি অফিসে, আয়কর আইনজীবী ও আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল হক ভূঁইয়ার কার্যালয়ে, জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার ও শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ চত্বরে আয়োজিত উন্নয়ন মেলায় আগুন দিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভাতেও হামলা করে হেফাজত কর্মীরা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশনে রেললাইনের কাঠের পাটাতনেও আগুন দেয়া হয়েছে। দুই দিন আগেও স্টেশনে আগুন দেয়ার ঘটনায় এই স্টেশনে ট্রেন থামা বন্ধ রয়েছে।
ভাঙচুর করেছে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়, ব্যাংক এশিয়া, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ পৌর মিলনায়তন, সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতায়ন এবং পরিবার ও পরিকল্পনা কার্যালয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় হেফাজত কর্মীরা।
এরপর হেফাজত কর্মীরা হামলা চালায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়ে। সেখানে ভাঙচুরের পাশাপাশি ধরিয়ে দেয়া হয় আগুন।
শ্রীশ্রী আনন্দময়ী কালীমন্দিরেও যায় হামলাকারীরা। পূজা চলাকালে তারা মন্দিরের আসবাব ও প্রতীমা ভেঙে দেয়।
হেফাজত কর্মীরা জেলা প্রেস ক্লাবে ভাঙচুর চালানোর সময় আহত হয়েছে রিয়াজুদ্দিন জামি। তিনি প্রেস ক্লাবের সভাপতি।
সদর হাসপাতালের চিকিৎসক রাব্বি নূর শামস নিউজবাংলাকে জানান, জামির মাথায় ছয়টা সেলাই দিতে হয়েছে।
হেফাজত কর্মীদের ইটের আঘাতে এটিএন নিউজের ফটোসাংবাদিক সুমন রায়ের দাঁত ভেঙে গেছে।
এ ছাড়া হরতাল সমর্থকরা রাস্তার ব্যানার, ফেস্টুন ছিঁড়ে সেগুলোতেও আগুন দিয়েছে।
স্থানীয় লোকজন জানায়, শহরের বাইরে থেকে প্রচুর লোক এসে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করছে। পুরো এলাকার পরিস্থিতি এখন থমথমে।
সকাল ৯টার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কোনো যানবাহন ছেড়ে যায়নি। এর আগে সকাল ৭টার দিকে একটি মালবাহী ট্রেন ঢাকার উদ্দেশে এবং এরপর ৮টায় পারাবত এক্সপ্রেস সিলেট যায়। এরপর আর কোনো ট্রেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওপর দিয়ে যায়নি।
তাণ্ডব চলেছে শুক্র ও শনিবারও
শনিবার সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে ছাত্রদের সড়ক অবরোধের পর সংঘর্ষের একপর্যায়ে পুলিশের গুলিতে পাঁচজন নিহত হন।
শহরের সুহিলপুর ইউনিয়নের নন্দনপুর এলাকার এই সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিরা হলেন সদর উপজেলার সুহিলপুরের জুর আলম, মজলিশপুরের সুজন মিয়া, বুধল গ্রামের বাসিন্দা কাওসার মিয়া ও মোহাম্মদ জুবায়ের এবং সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের বাদল মিয়া।
এদের মধ্যে সুজন মিয়া স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় পড়েন।
বাকিদের মধ্যে জুর আলম ওয়ার্কশপের কর্মী আর কাউসার ও জোবায়ের শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।
শুক্রবারের হামলা ছিল আরও ব্যাপক। সেখানে মাদ্রাসা থেকে মিছিল নিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় শহরের রেলস্টেশন। মৎস্য অধিদপ্তরের কার্যালয় ও আনসার ক্যাম্পে আগুন দেয়া হয় পেট্রল ঢেলে। পরে হামলা হয় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে। তখন গুলি চালায় পুলিশ। আর এক তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়।
স্টেশনে আগুনে সংকেতব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুপুর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর রেলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটে কোনো ট্রেন আর এই স্টেশনে যাত্রাবিরতি করছে না। বন্ধ হয়ে গেছে ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রুটে চলা তিতাস কমিউটারও।
শুক্রবার রাত থেকেই শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশ-র্যাব মোতায়েন করা হয়। টহল শুরু করে আধা সামরিক বাহিনী বিজিবিও।
এদিন হেফাজতের বিক্ষোভের ডাক নিয়ে শহরে উদ্বেগ থাকলেও পুলিশের নিরাপত্তার আয়োজন দেখে বিকেল পর্যন্ত রাজপথে নামেনি মাদ্রাসাছাত্ররা। তবে সন্ধ্যায় আবার তুলকালাম হয়।
এর মধ্যে হেফাজতের কেন্দ্রের পক্ষ থেকে শুক্রবার প্রতিটি ফোঁটা রক্তের বদলা নেয়ার ঘোষণা আসে। আর রোববারের হরতাল সফল করার ডাকও জানানো হয়।